Header Ads

ভাষার মিছিল

 


 

কিশোর গল্প

 ✍️ আমিনুল ইসলাম মামুন।।

 

ক্লাসে বসে আছে তাইফ। বেঞ্চের ওপর কনুই রেখে গালের নিচে হাত তার। পাশেই রাখা বইগুলো। বইয়ের ওপর রয়েছে লেখার কলমটিও। অন্যান্য দিন সে ক্লাসের অল্প আগে আসে। তবে আজ এসেছে বেশ কিছুটা সময় আগেই। একজন দুজন করে ক্লাসে ঢুকছে ছাত্র-ছাত্রীরা

রুবেল তাইফের বন্ধু। সেও ঢুকল ক্লাসে। ওদের মধ্যে সম্পর্কটা অন্যদের চাইতে একটু আলাদা। দুজনই প্রতিদিন প্রথম বেঞ্চে বসে। রুবেল আজ তাইফকে সামনের বেঞ্চে না দেখে কিছুটা অবাক হলো। তার ওপর তাইফকে চিন্তিত মনে হচ্ছে

উদাস ভঙ্গীতে জানালার বাহিরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সে। তাইফের পাশে গিয়ে পিঠে হাত রাখলো রুবেল। কিছু না বলে জিজ্ঞাসু ভঙ্গীতে তাকাল তাইফের দিকে। তাইফ রুবেলের দিকে তাকাল। তারপর ভারী কণ্ঠে বললপরীক্ষাটা মনে হয় আর দিতে পারব না রেশুধু আমিই নাআমাদের কেহই না

কেনকি হয়েছে?

বাবা রাতে ঢাকা থেকে এসেছেন। তিনি বললেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা

 

আবিদ মাস্টার চোখ কপালে তুললেন। বললেনবল কীতা হলে তো সর্বনাশ!

সাব্বির আর নাদেরকে বললেনতোমরা দুজন এখনই যাও। ওদেরকে যেখানেই পাও আমার কাছে নিয়ে এসো। তা না হলে বিপদ ঘটতে পারে

সাব্বির আর নাদের বেরিয়ে গেল। তাইফদের বাড়িতেই দুজনকে পাওয়া গেল। স্যারের কথা বলার পর ওরা রওনা হলো স্কুলের দিকে

ক্লাস শেষ করে আবিদ স্যার টিচার রুমে ওদের জন্য অপেক্ষা করছেন। এসে পড়ল ওরা। তাইফরুবেলসাব্বির আর নাদের দাঁড়িয়ে আছে। আবিদ স্যার চশমাটি খুলে টেবিলের ওপর রাখলেন। তারপর মাথা তুলে তাকালেন ওদের দিকে। তাইফকে জিজ্ঞেস করলেনতুমি আর রুবেল আজ স্কুলে আসনি কেন?

এসে কি লাভ হবে স্যারবাংলায় যদি কথাই বলতে না পারিপরীক্ষাই দিতে না পারি তাহলে স্কুলে এসে লাভ কী।  

রুবেল বললতাই আমরা ঠিক করেছি মিছিল করব। ঢাকার মতো। সামনে আমি থাকব। মরতে হলে আমি মরব। আমার মা বলেছেনআমি যখন কথা বলতে শিখি তখন আমার মুখ দিয়ে বের হয় ‘মা সেই মা বাংলাতে কথা বলেছেনবাবা বলেছেনদাদা বলেছেনদাদী বলেছেন। বাংলাকে তো কোন রকমেই বাদ দিতে পারব না স্যার

তাইফ বললশুনলেন তো স্যার। ঢাকায় রক্ত ঝরছে আর আমরা এখানে বসে থাকবথাকব না। গ্রামের মানুষকে নিয়ে কালকে মিছিল হবে। মায়ের ভাষা যারা কেড়ে নিতে চায়তাদের তাড়ানোই এখন আসল কাজ

 

সংগঠিত হত্যাকা-ের তীব্র প্রতিবাদ জানাতে হবে। এই বার্তা প্রতিটি ঘরে পৌঁছাতে হবে

তাইফ  রুবেল আগামীকাল যে মিছিলের কথা ভেবেছে সেটি সফল করতে হবে। সেজন্য সবাইকে সকাল দশটায় এখানে জড়ো হওয়া চাই। 

ছাত্র-ছাত্রীরা করতালির মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়

পরদিন সকাল দশটা। ছাত্র-শিক্ষকের পাশাপাশি বহু সচেতন লোক মিছিলে অংশগ্রহণ করে। সমবেত কণ্ঠে স্লোগান ওঠে-

 

নদী চিনি মাকে চিনি

প্রাণের দামে ভাষা কিনি।

 

বাংলা কেন রক্তে ভাসে

বসন্তের এই ফাগুন মাসে।

 

বাংলা ভাষা বাংলা ভাষা

বাবা-মায়ের সকল আশা।’ 

 

আকাশ আমার ভাষা আমার

নেই তো সুযোগ আজকে থামার।

 

দৃপ্ত পায়ে চল রে সবে

 

পাকিস্তানীদের  ঘোষণা মানা যায় না। আমাদের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা। এই দাবিতে মিছিল করতে গেলে পুলিশ সেখানে গুলি করে। কয়েকজন মারাও গেছে

রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়ানা হওয়া নিয়ে আগে থেকেই কথা শুনছি। এখন তো পরিস্থিতি তাহলে ভয়ঙ্কর!

তাই তো দেখছি

কথা শেষ হতে না হতেই ঘণ্টা পড়ল। স্যারও যেন ঘণ্টা পড়ার অপেক্ষাতেই ছিলেন। তিনিও শ্রেণিকক্ষে এসে হাজির। ঢাকায় মিছিলে পুলিশের গুলির বিষয়ে তিনিও জানেন

চোখে মোটা ফ্রেমের ভারী চশমা পরা আবিদ স্যার। অন্যদিন তিনি বেত হাতে কক্ষে প্রবেশ করলেও আজ তার হাতে বেত নেই। শুধু হাজিরা খাতা আর ডাস্টার। তিনি কক্ষে এসে চেয়ারে বসলেন কিছুক্ষণ। এরপর ক্লাস শেষ করে তিনি বেরিয়ে গেলেন

সারাদিন তাইফ আর রুবেল  নিয়েই আলোচনা করল। তাদের কথা থেকে ক্লাসের প্রায় সকলেই  বিষয়ে অবগত হলো। স্কুল ছুটির পর তারা দুজন মাঠের এক কোণায় গিয়ে বসল। কি যেন শলা-পরামর্শ করল কিছুক্ষণ। তারপর বাড়ি ফিরে গেল

পরদিন যথারীতি ক্লাসে ঢুকলেন আবিদ স্যার। রোল কল করলেন তিনি। কয়েকজন অনুপস্থিত। কিন্তু তাইফ আর রুবেলের বিষয়টি তার নজরে এলো। ছাত্র-ছাত্রীদেরকে জিজ্ঞেস করলেন তাইফ আর রুবেলের বিষয়ে। কেউ কিছু বলছে না। একটি মেয়ে দাঁড়াল। নাম জেবা। সে বললস্যারকালকে ওদেরকে ভাষা আন্দোলন নিয়ে কথা বলতে শুনেছি। মনে হলো  বিষয়ে ওরা কিছু একটা করতে যাচ্ছে

 

 

সাব্বিরের চোখ ঝলঝল করে উঠল। অতি আবেগি কণ্ঠে সে বললআগে মিছিলতারপর ক্লাস

নাদের বললস্যার কালকে মিছিল। আমরা কেউ আসব না

আবিদ স্যার দাঁড়ালেন। নরোম গলায় বললেনশান্ত হও। তাইফ আর রুবেলকে লক্ষ্য করে বললেনআমি বুঝতে পেরেছি তোমরা এমন একটা কিছু করতে যাচ্ছ

তাই তোমাদেরকে ডেকেছি যেন বিপদে না পড়। বুঝতে পেরেছি ঢাকার ঘটনা তোমরা সবাই জেনেছ। পরিস্থিতি ভালো না। এলোমেলোভাবে কাজ করে বিপদ ডেকে আনা ঠিক হবে না

তবে তোমাদের মানসিকতার প্রশংসা করতে হয়। তোমরা ক্লাসে গিয়ে বস। ক্লাস শেষে তোমাদের সাথে কথা বলব

ওরা ক্লাসে চলে গেল

আবিদ স্যার প্রধান শিক্ষকের সাথে বেশ কিছু সময় কথা বললেন। কিছুক্ষণ পর সকল শ্রেণিকক্ষে নোটিশ এলো। ছাত্র-ছাত্রীদেরকে জানানো হলো স্কুল ছুটির পর মাঠে সমবেত হতে

স্কুল ছুটি হলো। এক এক করে সবাই মাঠে জড়ো হতে লাগল। কিছুক্ষণ পর প্রধান শিক্ষক এলেন। ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে কথা বললেন। ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের মিছিলে পুলিশের গুলির বিষয়ে বিস্তারিত জানালেন। তারপর বললেনআমাদের দুজন ছাত্র ঢাকার ঘটনার প্রতিবাদে কর্মসূচি হাতে নিতে চলেছে

বিচ্ছিন্নভাবে কর্মসূচি দিলে ফল আসার বদলে বিপদই আসে। তাই আমাদেরকে সংঘবদ্ধ হতে হবে। মায়ের ভাষার সম্মান রক্ষায় কাজ করতে হবে। ঢাকায়

 

বাংলা আমার ভাষা হবে।

 

আকাশ-বাতাস কাঁপাচ্ছে শিক্ষকছাত্র-ছাত্রীসচেতন মানুষের এই অগ্নিমিছিল। গাঁয়ের মেঠো পথ ধরে এগিয়ে চলছে মিছিলটি। রাস্তার পাশে কৃষকেরা হাত উঁচিয়ে হাসিমুখে অভিনন্দন জানায় মিছিলকারীদের। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.