কবিতায় জাগরণ (জানু-মার্চ-২০২০)
যারা এই সংখ্যা কে আলোকিতো করেছেনঃ
১. লাল সবুজের পতাকা -মাসুদ রানা
২. ভুল -কাজী আনিসুল হক
৩. মায়ের মুখের ভাষা -আমিনুল ইসলাম মামুন
৪. ভাই হারানোর ব্যাথা -করুণা আচার্য
৫. আছি অনেক সুখে -এস এম জুনেদ জামান
৬. স্বাধীনতা -ইদ্রিস রহমান
৭. বর্গী গেল উঠোন ছেড়ে -দালান জাহান
৮. ২১ আমার -অভিলাষ মাহমুদ
৯. হৈমন্তিকা -মিজান মনির
১০. ভাষার অহংকার -সাহিদা রহমান মুন্নী
১১. ফাগুন এসো না মোর চিত্তে -মোঃ বদিউল আলম বাচ্চু
১২. পতাকা তোমায় লাল সালাম -মোহা: জেইনাল আবেদীন চৌধুরী
১৩. বিজয় আমার -ফরিদুজ্জামান
১৪. স্বর্গ-ভূমি -গোলাম রব্বানী টুপুল
১৫. প্রিয় স্বাধীনতা -আবু ইউসুফ সুমন
১৬. স্বাধীনতা তুমি -মাহবুব আহমেদ
১৭. মাঘ সংক্রান্তির সেকাল একাল -তুলোশী চক্রবর্তী
১৮. তোমার প্রতিক্ষায় দীর্ঘ ৪৮ বছর -রিলু রিয়াজ
১৯. স্বাধীনতার স্বপ্নপুরুষ -নির্মলেন্দু পোদ্দার
২০. প্রাণের প্রণতি নাও হে মাতৃভাষা – ইলিয়াস বাবর
সম্পাদকীয়ঃ
লেখা দিয়ে যারা পাশে রয়েছেন তাদের সকলের কাছে কবিতায় জাগরণ পরিবার আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে,
পথ যতোই কঠিন হোক হাঁটব এই অঙিকার ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছি, পৃথিবীর সর্বত্র জয় হোক মানুষের জয় হোক মানবতার!
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নাভিশ্বাস জনজীবন! ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট নির্মূল হোক স্বস্তি ফিরে আসুক জীবন থেকে জীবনে! যার যা আছে তা দিয়ে শীতার্তদের পাশে দাঁড়াতে হবে, হেরে যাক শীত, জিতে যাক মানবতা,,,,
উন্মুক্ত হোক ছন্দের সীমানা, সাহিত্যের সপ্তডিঙায় পাল তুলুক ছন্দ!! কবিতায় জাগরণ আপনার আমার সবার পরিবার---
সবসময় পাশে থাকুন,আজীবন অটুট থাকুক ভালোবাসার এই বন্ধন!!
সম্পাদক
সাহিদা রহমান মুন্নী
লাল সবুজের পতাকা
মার্চ মাস, ১৯৭১ সন! বাংলাদেশের ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়! পাকসেনারা আধিপত্য বিস্তার করল বাংলার পবিত্র ভূমিতে! রাষ্ট্র ভাষা বাংলা নয় হতে হবে উর্দু ! সেই ভয়াল মার্চ, বাংলার আকাশে ঘনঘটা, রাতের আধারে বুকের তাজা রক্তে ভেসে গেল ঢাকার রাজপথ! ভাষার জন্য তথা দেশের জন্য পেতে দিল বুক বাংলার দামাল ছেলেরা! উত্তপ্ত হয়ে উঠল বাংলার মাটি, মাথায় কাফন বেধে বাংলার দামাল ছেলেরা, নারী পুরুষ সর্বস্তরের মানুষ বাংলাকে রক্ষার্থে পেতে দিল বুক।
নেমে পড়ল বন্দুক হাতে ভাষা তথা দেশ রক্ষার তরে! লাখো মা'বোন হারাতে লাগল তাদের ইজ্জত! লাখো ভাই হয়ে গেল শহীদ! আগুনে পুড়েছে কত বাড়ী কত ঘর! হয়েছে ছারখার হয়েছে নিঃস্ব, হারিয়েছে কত মা তার সন্তান, হারিয়েছে কত সন্তান তার বাবা
মাকে! যন্ত্রনার আগুন বুকে নিয়ে দেশের তরে লড়েছে তারা! বাংলার প্রতিটি মানুষ যেন একএকজন মুক্তি সেনা! দেশ রক্ষার্থে দিয়েছে প্রান কত পুলিশ,সামরিক,বিমান ও নৌ সেনা! এভাবেই চলেছে দীর্ঘ ন'টি মাস!
আমি দেখেছি সেই একাত্তুরের ভয়ালযুদ্ধ! দেখেছি মুক্তিবাহিনীদের দৌড়াত্য! দেখেছি পাক সেনাদের হিংস্রতা! দেখেছি কত ইজ্জত হারানো মা বোনের নিরব কান্না! দেখেছি কত লাশ, নাষিকাতে পেয়েছি কত পচা লাশের গন্ধ, অনুভব করেছি বারুদের গন্ধ, ছুটেছি একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রন্তে, করেছি লড়াই শুধুই বেচে থাকার! দিয়েছি খাবার, মিটিয়েছি পিপাসা কত মুক্তিসেনার! হয়তো পারিনি তুলে নিতে হাতে বন্দুক! কতইবা বয়স ছিল তখন আমার! মাত্র দশ বছরের এক বালক আমি! এর থেকে বেশী আর কিবা করার ছিল আমার! দীর্ঘ নয় মাস পর বাংলার আকাশে জয়ের পতাকা উঠল! ১৯৭১ সাল ১৬ই ডিসেম্বর!
মুক্তি সেনাদের দুর্দান্ত সাহসীকতা আর বাংলার সেনাদের অস্ত্রের মুখে কুপুকাত হল পাক সেনারা! তাদের নিশ্চিত পরাজয় জেনে আত্নসমর্পন করল ইয়াহিয়া! বাংলার আকাশে উদয় হল লাল সবুজের পতাকা। লাখো পাক সেনা দলে দলে বাংলার বিভিন্ন জায়গা থেকে মিলিত হতে লাগল ঢাকায়! আমরা হারালাম লাখো মা'বোনের ইজ্জত! হারালাম বুক পেতে দেয়া লাখো শহিদ ভাইকে! যাঁদের এতো ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমাদের এই সোনার বাংলা! আমি তোমায় ভালোবাসি!!
...................................................................................
ভুল
কাজী আনিসুল হক
ভুল করে ভুলে যাই রাষ্ট্রের চাওয়া
লাশ আর রক্ত, লাঞ্ছনা পাওয়া
ভুল করে ভুলে যাই শহীদে'র দেশ
পশ্চাৎ দানবিক আজকে স্বদেশ।
ক্ষমতা মসনদ রাতারাতি খ্যাতি যশ
রাজনীতি পেশা হলে নেতা হবে বস
ভুল করে ভুলে যাই সংগ্রাম ইতিহাস
জাতি ভেদ বজ্জাতি যায় করে উপহাস
ভুল করে ভুলে যাই নাগরিক অধিকার
বাবা মায়ের স্বপ্ন বাংলায় স্বাধিকার
লুটপাট, গুম-খুন, জুয়া আর মদ_
রাত হলে হুর পাবে যদি থাকে পদ।
ভুল করে ভুলে যাই মানবিক আমাকে,
ভুল করে ভুলে যাই ভালোবাসি তোমাকে...
...................................................................................
মায়ের মুখের ভাষা
আমিনুল ইসলাম মামুন
বাংলা আমার মায়ের মুখের ভাষা
বাংলা বাবার স্বপ্ন জয়ী আশা
বাংলা হাসে এই সবুজের বুকে
বাংলা হাসে বাবা-মায়ের মুখে।
শব্দ দানব আসলো সেদিন ছুটে
বারুদ গলা গর্জে তখন ওঠে
তপ্ত হলো রক্ত ভেজা মাটি
সবার বুকে দরদ ছিল খাঁটি।
অগ্নিমাখা শব্দগুলো ঝরে
ভাষা খেকোর ভীতটা তখন নড়ে
মায়ের ভাষা কণ্ঠে ওঠে বেজে
সেনানীদের পথটা রোখে কে সে?
মায়ের ভাষা দেয়নি ওদের নিতে
রক্ত দিলো ভাষার বিপরীতে
বাংলা ভাষা বিশ্ব জুড়ে হাসে
পরশ ছড়ায় সবুজ হৃদয়-ঘাসে।
বাংলা ভাষা রক্ত রঙে আঁকা
বাংলা সবার হৃদয় আবেগ মাখা
বাংলা শুনি মুক্ত পাখির ঠোঁটে
এই ভাষাতে হৃদয়ে ফুল ফোটে।
...................................................................................
ভাই হারানোর ব্যাথা
করুণা আচার্য
ছোট্ট সোনার ভাইটি আমার ঘুড়ি হাতে খেলতো
মনের সুখে এদিক ওদিক খুশির ডানা মেলতো।
কারো বিপদ দেখলে পড়ে উর্ধশ্বাসে ছুটতো
হাসি খুশি ভাইটি আমার ব্যাথা ধরে রাখতো।
তার খুশিতে আমরা সবাই মুখ লুকিয়ে হাসতাম
তার দুঃখে সবাই আবার হু হু করে কাঁদতাম।
অত্যাচারির কন্ঠ রোধে প্রাণ পণ সে লড়তো।
ঐক্য- শান্তি -ভালবাসায় দেশ ও সমাজ গড়তো।
যে দিন দেখি ভোর বেলাতে ভাইয়ের মৃত লাশ
আকাশ ভেঙ্গে পড়ল মাথায়একি সর্বনাশ।
রক্তমাখা হাতের লেখা ধরলো চেপে ভাই
মায়ের নামটি আছে তাতে ভাইটি আমার নাই।
ভাই হারানোর ব্যাথায় আজো ঘুরি অলি গলি
আসবে বলে পথের ধারে আপন মনে চলি।
অভিমানি ভাইটি আমার আসবে না তো আর
শহীদ মিনার লুকিয়ে আছে সোনার দেহ তার।
...................................................................................
এ বিজয় রক্তাক্ত হৃদয়ের বিনিময়ের
এস এম জুনেদ জামান
এমনি হঠাৎ এসোনি, এসেছো অনেক রক্তঝড়া স্রোতের প্লাবনে,
এসেছো ঘুর্ণিঝড়-টর্নেডো ধ্বংসাত্মক ক্ষতিগ্রস্তের
মর্মান্তিক বিস্ফোরণে!
এসেছে তারুণ্যের জীবনবাজি দিয়ে, বীরত্বের
উচ্চস্লোগানে।।
আকাশ ফাটা রক্তোক্ত অগ্নিবৃষ্টি নেমেছিলো
এই মৃত্তিকাতে,
ছিলনা ভেদাভেদ, দিবা-রাত্রি, বেদনাময়!
সন্ধ্যা প্রভাতে --
মমতাহীন ভালোবাসা হারিয়ে গিয়েছিলো
হিংস্রের স্রোতে।।
রক্ত চুষা হায়নাদের ভয়ে, নিঃশ্বাস বন্ধ ছিলো
বাকরুদ্ধ হয়ে,
পাঁ ফেলতে বারণ, নিষিদ্ধ যড়ষন্ত্রের বেড়াজ্বালে
সাবধান! নিঃসঙ্গ হয়ে--
জমাট বাঁধা কান্নাগুলি দাউ দাউয়ে পোড়া অনলে
ব্যথাগুলো সয়ে।।
এমনি করে এসেনি, এসেছে, উত্তম পূর্বপুরুষদের
রণাঙ্গের কাঁধে চড়ে,
হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে, এনেছেই ওরা, রক্তাক্ত স্নানে,
তারপরে --!!"
কেঁদেছে, কেঁপেছে বাংলায় আপাদমস্তক! ভয়ানক!!
শব্দহীন চিৎকারে।।
ফুটে ফুল , সুভাসে জুড়ায় দু-কূল, চিত্তের বৃত্তে গুলবাগে মনের হরষে,
পেয়েছি, চেয়েছি যা, তব কুলে মাথা রেখে দুলে দুলে
তন্দ্রা অবশেষে --
যত দেখি ততই ভালোবাসি, ভাসতে হয় স্মৃতিময়
ঐ করুণ দৃশ্যে।
...................................................................................
স্বাধীনতা
ইদ্রিস রহমান
স্বাধীনতা তুমি মায়ের মুখের এক চিলতে হাসি
স্বাধীনতা তুমি মাঠে প্রান্তরে রাখালের বাঁশের বাঁশি।
স্বাধীনতা তুমি পল্লী কবি জসিম উদ্দিনের কবিতাগুলি
স্বাধীনতা তুমি জয়নুল আবেদীনের ছবি আঁকা রং তুলি।
স্বাধীনতা তুমি সন্তান হারা লাখো মায়ের ক্রন্দন
স্বাধীনতা তুমি আঠারো কোটি বাঙ্গালীর স্পন্দন।
স্বাধীনতা তুমি বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের সে ভাষন
স্বাধীনতা তুমি লাখো মুক্তিযোদ্ধার হাতিয়ারের গর্জন।
স্বাধীনতা তুমি সোহরাওয়ার্দী, ভাষানির বুকের জ্বালাময়ি হাহাকার
স্বাধীনতা তুমি একাত্তরে গর্জে ওঠা আবাল বৃদ্ধ বনিতার।
স্বাধীনতা তুমি কৃষকের ফলানো সোনালী ফসলের ছবি
স্বাধীনতা তুমি শহীদের রক্তে রাঙানো প্রথম সকালের রবী।
স্বাধীনতা তুমি পদ্মা, মেঘনা, যমুনার ঢেউয়ের কলতান
স্বাধীনতা তুমি মায়ের কোলে শিশুকে ঘুমপাড়ানো গান।
স্বাধীনতা তুমি আব্দুল আলিমের পল্লী গানের সুর
স্বাধীনতা তুমি নকশি কাঁথা প্রতিটা গাঁয়ের বধুর।
স্বাধীনতা তুমি শিশুর আগামী সোনালী স্বপ্নের হাসি
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।
...................................................................................
বর্গী গেল উঠোন ছেড়ে
দালান জাহান
পাখিগুলো বন্দি ছিল
উড়ছিল না ভয়ে
রক্ত-কবর ভাসছিল তাই
হাজার জীবন ক্ষয়ে।
মুক্তি পাগল মানুষগুলো
জ্বলছিল সেই শোকে
প্রতিরোধের আগুন হয়ে
অস্ত্র নিল বুকে ।
কৃষক শ্রমিক কর্মচারী
রইলোনা কেউ বাকি
যুদ্ধ জয়ের শপথ নিয়ে
পোড়ল পাকের খাকি ।
রক্তঝরা ইতিহাসে
হৃদয় হলো লাল
বর্গী গেল উঠোন ছেড়ে
ওড়ল স্বাধীন পাল ।
...................................................................................
২১ আমার -
অভিলাষ মাহমুদ
২১ আমার -
স্নেহময়ী জননীর কোমল হাত।
২১ আমার -
দু'চোখ ভরা স্বপ্ন সুখের রাত।
২১ আমার -
মায়া মাখা পুত্রের নরম গাল।
২১ আমার -
পতাকার ভেতর সবুজ এবং লাল।
২১ আমার
নাড়ি ছেড়া বুকের মানিক ধন।
২১ আমার -
কন্যা জায়া সুখে ভরা মন।
২১ আমার -
বর্ণ হাজার লিখার মধুর ছন্দ।
২১ আমার -
সুখের বাগান মনের আনন্দ।
২১ আমার -
বাবার আদর বাংলা ভাষার মান।
২১ আমার -
জীবনানন্দ মহামিলনের গান।
...................................................................................
হৈমন্তিকা
মিজান মনির
গভীর রাত- হঠাৎ চমকে উঠি
চোখ যায় দখিনা জানলায়
শৈত্য প্রবাহের কুয়াশা ঘেরা প্রকৃতি
মৃদু শীতল হাওয়া আলতো ছুঁয়ে গেলো শরীর
মনে পড়ে যায় উষ্ণ আলিঙ্গন...
আমায় ছুঁয়ে-বুকে রঙধনু হয়ে ভাসো,
ছুঁতে চাই পারি না
তৃষ্ণার্ত চোখ-ঠোঁট পেতে চাই উষ্ণ ভালোবাসা,
যে ভালোবাসার তাপে শুকিয়ে যাবে শিশির!
বাকি রাত অঙ্গে অঙ্গে কর্ষণ, দহন-বর্ষণ
সঙ্গী দু’জোড়া হাত
সাথে আছে হেমন্ত রাত!
...................................................................................
ভাষার অহংকার
সাহিদা রহমান মুন্নী
আমার ভাষায় বলছি কথা,
এইতো আমার সুখ -
আশার আলোয় চলছি পথে,
দেখছি মায়ের মুখ !
বর্ন মালার বর্ন দিয়ে,
গাঁথতে পারি মালা -
এই ভাষাতে শক্তি এতো,
ঢাকতে পারি জ্বালা !
বিশ্ব বুকে গর্বে আজি,
উচ্চে উঠে শির -
বর্ন ভাষা মাতৃ - মাকে,
আনলো কোটি বীর !
আকাশ খোলা মুক্ত বাতাস,
দেশের অলংকার -
প্রানের দামে আনলো একুশ,
ভাষার অহংকার !
...................................................................................
ফাগুন এসো না মোর চিত্তে
মোঃ বদিউল আলম বাচ্চু
ফাগুন এসো না তুমি মোর চিত্তে অগ্নিপ্রলয়ের বহ্নিসখ হয়ে ,
ফাগুন এসো না তুমি , প্রবাহিত রক্তের নির্ঝরিনী স্রোত হয়ে,
ফাগুন এসো না তুমি রক্তাত্ব নিহত সন্তানের মাতার ক্রন্দন হয়ে ,
ফাগুন এসো না তুমি সন্তানহারা পিতার হৃদয়ের আর্তনাদ হয়ে ,
ফাগুন এসো না তুমি নিস্পাপ যুবকের বেঁচে থাকার আকুতি নিয়ে ,
ফাগুন এসো না তুমি একজন মেধাবী ছাত্রের জীবন কেড়ে নিতে,
ফাগুন এসো না তুমি ছোট্ট শিশুর ভাতৃহারা হাহাকার হয়ে ,
ফাগুন এসো না তুমি পিতামাতার লালিত স্বপ্ন ছিনিয়ে নিতে ,
ফাগুন এসো না তুমি বোনের প্রিয় ভাইটিকে না ফেরার দেশে নিয়ে যেতে ,
ফাগুন এসো না তুমি একজন তরতাজা যুবকের প্রান কেড়ে নিতে,
ফাগুন এসো না তুমি প্রানপ্রিয় বন্ধুদের বিচ্ছিন্ন করে একাকী করে দিতে ,
ফাগুন এসো না তুমি স্বপ্ন দেখা যুবকের স্বপ্ন ভেঁঙ্গেচূড়ে চুরমার করে দিতে।
ফাগুন এসো না তুমি প্রিয়তমার হৃদয়ের পোষা স্বপ্ন ছিনিয়ে নিতে ।
ফাগুন এসো না তুমি রক্ত ঝড়া অগ্নিমলয় , অগ্নিপ্রলয় প্রহসন হয়ে ।
ফাগুন তুমি এসো না একটি সংসারে সমস্ত আশা আখাংকা, স্বপ্ন ভেঁঙ্গে দুঃখে সাগরে ভাসিয়ে দিতে ,
ফাগুন এসো না তুমি কারো হৃদয়ের চিরদুঃখ ,চিরকান্না হয়ে ।
এসো সূর্যমুখি ডালিয়া ফুলের রঙ্গে রঙ্গে রাঙ্গিয়ে ভালোবাসার সওগাত নিয়ে ,
এসো একটি সুখী সংসারের রঙ্গিন স্বপ্ন বাস্তবায়ণ করার জন্যে ।
...................................................................................
"পতাকা তোমায় লাল সালাম"
মোহা: জেইনাল আবেদীন চৌধুরী,
একটি ঠিকানা তার নাম মানচিত্র,
একটি স্বত্তা তার নাম পতাকা;
মা-এর ভাষা বাংলায় কথা,
এই তো ছিল মোদের যুদ্ধের বারতা।
পেয়েছি মানচিত্র পেয়েছি পতাকা,
এখন বাংলা রেখে ইংলিশ-এ বলি কথা;
পেটে নিয়ে অবারিত ক্ষুধা!
কোথায় আমাদের স্বাধীনতা?
রাস্তায় চলতে জীবনের ভয়,
একটু সচ্ছল হলে চাঁদা দিতে হয়;
না দিলে পরে জীবন দিতে হয়।
এই কি আমাদের স্বাধীনতার জয়?
আমি চাই না এই স্বাধীনতা,
এমন পতাকা, যার থাকে না কোনো মান-মর্যাদা।
সীমানা নিয়ে ধোঁকাবাজি শুধু,
স্বাধীনতার উদ্দেশ্য ছিল কি এই সুধু?
কত তাঁজা প্রানের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা,
কিভাবে খেলছে ওরা, নিয়ে এই দেশ-টা;
নিষ্প্রাণ জাতি চেয়ে দেখছে শুধু।
ওরে ও ভাই বীর বাঙালী,
জেগে উঠ তোরা, হাতে ধর তরবারি;
যেমন জেগেছিলি একাত্তুরের ডাকে,
বুঝিয়ে দে পশুদের, আমরা নই কাঙ্গালী, আমরা বীর বাঙালী।
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত, তোঁরা সেই দিন হবি শান্ত,
যেদিন থাকবে না কোনো চাঁদাবাজি-সন্ত্রাসী;
ঘোষ-দালালি, এসিডের ভয়াবহতা সব হবে বন্ধ।
পতাকা তুমি তোমার রবে মর্যাদা,
মানচিত্রের রেখা রবে আঁকা বুকে;
একে-ওপরে আমরা চলব সুখে-দুখে।
আমি দেখি স্বপ্ন, সেদিন বেশি দুরে নয়,
আমাদের স্বাধীনতার হবে চির জয়।
...................................................................................
বিজয় আমার
ফরিদুজ্জামান
বিজয় আমার চির চাওয়ার চির পাওয়ার ধন
বিজয় আমার মুক্তিপথের অনন্ত আয়োজন
বিজয় আমার অশেষ সোপান শীর্ষ পথের সিঁড়ি
বিজয় আমার হীরাজহরত রত্নপূর্ণ গিরি
বিজয় আমার শক্তির আধার প্রণোদনার মন্ত্র
এর প্রেরণায় অসুর বিনাশে ছিন্ন ষড়যন্ত্র
বিজয় আমার আলোর দিশারি অন্ধকারে প্রদীপ
বিজয় আমার জাতির ললাটে বীরত্বে ছাপা টিপ
বিজয় আমার শত পরাজয়ে বিপরীতে ফোটা ফুল
বিজয় আমার উজানস্রোতের বাইচজেতা নির্ভুল
বিজয় আমার অন্ধকারের বোটায় ফোটা সূর্য
দেশপ্রেমিকের অন্তর জুড়ে অবিরল রণ তূর্য
বিজয় আমার বুকের মশাল শিখা অনির্বাণ
বিজয় আমার নিযুত শহীদ মৃত্যুঞ্জয়ী গান
বিজয় আমার মুক্তিযোদ্ধার রক্তরাঙানিশান
বিজয় আমার উন্নতশির জগতের সেরা মান
বিজয় আমার দোয়েলের শিসে আনন্দ ঝংকার
বিজয় আমার শত্রুর প্রতি ব্রাঘ্রের হুংকার
বিজয় আমার জাতির পিতার তর্জনী-ওংকার
বিজয় আমার বাঙালির তেজ জাতির সারাৎসার
...................................................................................
স্বর্গ-ভূমি
গোলাম রব্বানী টুপুল
প্রজাপতি ছিল যেন পাতার নুপুর
পাখা দুটি মেলে ধরে সকাল দুপুর
ফুলে ফুলে উড়ে চলে মধু-তৃষা বুক
সুধা গিলে পাখা মেলে আহা কী'যে সুখ।
দুপুরের কড়া রোদে ঝিঁঝিদের গান
গলা ছেড়ে গায় সবে মন হরা তান
সন্ধ্যায় বাতি জ্বালে জোনাকের দল
বাতাসের বেগে নাচে পুকুরের জল।
আকাশের কোলে জাগে পূর্ণিমা চাঁদ
আহারে স্বর্গ-ভূমি বাঁচিবার সাধ
ফুল পাখি তরুলতা অপরূপ দেশ
যতদিন বেঁচে থাকি সুখ অনিঃশেষ।
...................................................................................
প্রিয় স্বাধীনতা
আবু ইউসুফ সুমন
একাত্তরে রক্তে কেনা
প্রিয় স্বাধীনতা
বহন করে শোকের স্মৃতি
বর্বরতার কথা।
কেমন ছিলো অবিভক্ত
পাকিস্তানের রূপ?
বলতে গেলে মন কেঁদে দেয়
ঐতিহাসিক চুপ!
হাজার রকম তকমা দিয়ে
পূর্ব পাকিস্তানে-
ছিলো শুধু হিংসে শোষণ
বৈষম্য সবখানে।
কিন্তু শেষে পাক হানাদার
খেললে জীবন নিয়ে
ডাক দেয় মুজিব স্বাধীনতার,
চোখটাকে রাঙিয়ে।
পঁচিশের ওই গণহত্যার
নির্মমতার গল্প
যুদ্ধ বিনে রাখেনি তো
আর কোনো বিকল্প।
বেতারে তাই স্বাধীনতার
ঘোষণা পাঠ হলে
দেশ স্বাধীনে যুদ্ধে নামে
মানুষ দলে দলে।
এমন ভাবেই আমরা পেলাম
সোনার বাংলাদেশ
অভয় নিয়ে ফেলার জন্যে
প্রতিটি নিঃশেষ
...................................................................................
স্বাধীনতা তুমি
- মাহবুব আহমেদ
স্বাধীনতা তুমি
সপ্তবর্ণা রঙধনু,
শুকতারা আর সন্ধ্যাতারা।
স্বাধীনতা তুমি
সৌন্দর্য্যমন্ডিত প্রার্থনা গৃহে
রূপালী রক্তিমাভা।।
স্বাধীনতা তুমি
কবি প্রাণের দোলা
দেশ সেবক আর
দার্শনিকের মূলধন।
স্বাধীনতা তুমি
মনের গহীন সায়রে মুক্ত মলয়
সজীব আলোক সঞ্চরণ।।
স্বাধীনতা তুমি
অগ্নি লেলিহান প্রজ্জলিত গৃহে
সু-শীতল সমীরণ।
স্বাধীনতা তুমি
বাঙালি জাতির এক
আশ্চর্য উত্তরণ।।
...................................................................................
মাঘ সংক্রান্তির সেকাল একাল
তুলোশী চক্রবর্তী
শীতে সাদা চাদরের মতো
চারিদিকের কুয়াশা ভরা পরিবেশ
মাঝে মাঝে মনে হয় এ যেন
ধোয়াময় স্বর্গ রাজ্য বিশেষ ,
সেই কয়েকটা বছর আগের
গ্রামের শীতের কথা খুব মনে পড়ে,
সেকালে সবার বাড়িতে বাড়িতে
মাঘ সংক্রান্তির নিমন্তন করে,
অগ্রায়নের নতুন ধানের উৎসব
শেষ হলে পরে
ধানের বিনীময়ে মাটির হাড়ি পাতিল কিনতো
আমাদের গ্রামের প্রতি ঘরে ঘরে,
মাঘ সংক্রান্তির আগের রাতে
পিঠা বানাতো বাড়িতে বাড়িতে
বহু রকমের পিঠায়
পরিপূর্ন থাকতো মাটির হাড়িতে হাড়িতে,
সংক্রান্তির ভোরে উঠে
হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় স্নান সেরে প্রত্যেকে,
শুকনো পাতার গাদায় আগুন জ্বালিয়ে
চারধারে গোল করে বসতো একে একে,
অতপর গল্পের সঙ্গে সমান তালে
চলতো পিঠা খাওয়া
মিঠা পিঠার গন্ধে ভরে যেতো
শীতের শীতল হাওয়া,
আর একালে মানুষ বিলাসিতায় কাটায়
লুপ্তপ্রায় সব সংক্রান্তি,মন ভরেছে হিংসায়,
তাই মাঘ সংক্রান্তির মিলনোৎসবের সুখ
আর আসেনা এই দরজায়।
...................................................................................
তোমার প্রতিক্ষায় দীর্ঘ ৪৮ বছর
রিলু রিয়াজ
দ্বি-তত্তের ভিত্তিতে আমরা হলাম পাকিস্তানী-
ওরা ভারতীয়
ধর্ম নিরপেক্ষ- সম্প্রীতির বন্ধনে বাঁধা
বহু বছরের লালিত স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে
আমরা হলাম শুধুই মুসলমান।
এরপর দীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাস…
শোষণ নিপীড়ন আর হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ।
দীর্ঘ ২৪ বছরে দুঃশাষন
শোষন আর বঞ্চনার বৃত্ত ভেঙ্গে
অবশেষে এলো সেই সাহসী উচ্চারণ-
“এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম”
এর পর যুদ্ধ, যুদ্ধ আর যুদ্ধ…
বীর বাঙ্গালী গৌরব গাঁথায় সমৃদ্ধ
৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শেষে আমরা স্বাধীন হলাম
পেলাম স্বপ্নের স্বাধীন স্বদেশ..
কিন্তু মুক্তি? হায়রে মুক্তি
তোমারই প্রতিক্ষায় দীর্ঘ ৪৮ বছর…
...................................................................................
স্বাধীনতার স্বপ্নপুরুষ
নির্মলেন্দু পোদ্দার
স্বাধীনতার রহস্য সন্ধানে
একান্ত তপস্যায় জাতির স্বপ্নপুরুষ
সেদিনের রেসকোর্স ময়দানে
আত্মশুদ্ধির উন্মুক্ত মঞ্চে
লাখো জনতার প্রণোচ্ছল মিছিলে
দ্বিধাহীন পূর্ণতা পায়।
শোষকের নাগপাশ ভেঙে দৃড় উচ্চারণ-
‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’
বিপ্লবী কবিতার মত
পরতে পরতে সাজানো ছন্দে মাত্রায়
মুক্তির সীমান্ত অপার।
উদ্বেলিত জনসমুদ্রে- প্রবাদ পুরুষ
স্বাধীনতার স্বপ্ন বুনে যায়।
জনকের বাণী- বেদমন্ত্রের মতন
সময়ের মিছিলে আকণ্ঠভার
মুষ্টিবদ্ধ হাতে- তর্জণী তুলে
স্বাধীনতা অর্জনের প্রতিজ্ঞায় অবিচল।
...................................................................................
প্রাণের প্রণতি নাও হে মাতৃভাষা
ইলিয়াস বাবর
গুরুজি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাতাসের ভেতর থেকেও বায়ুর উপস্থিতি টের পাই না বলে যে কথাটি জানান- তা যুগের স্বপক্ষে বদলে নিয়ে বলতে পারি- মাতৃভাষার মায়াময় আবহের মধ্যে থেকেও হয়তো বুঝতে পারি না তার টিকরে পড়া সৌন্দর্যের কথা। হয়তোবা বুঝি কখনোসখনো। একবার বিদেশি ভাষা শিক্ষা কেন্দ্রের পরীক্ষায় বিপুল বিদেশী ভাষার মাঝে অ আ দেখে অপার্থিব আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিলাম; অব্যক্ত উল্লাসে ঘেমে একাকার হয়েছিলাম নাতিশীতোঞ্চ অঞ্চলে থাকবার পরেও! চাটগাঁ নগরের রাস্তায় যানযটবহুল সময়েও কি এক অপরিমেয় সুখানুভূতি নিয়ে ঘরে এসেছিলাম সেদিন।
এভাবে- প্রথম বলতে শেখবার সময়, প্রথম প্রেমে পড়বার সময় কিংবা প্রথম প্রেমপত্র কি কবিতা লেখবার সময় মধুসিক্ত হর্ষরা ভর করে; অত:পর আমরা জেনে যাই মাতৃভাষার পবিত্রতা- পেয়ে যাই অবগাহন করবার শক্তিও।
বৈজ্ঞানিক নানাবিধ আবিষ্কারের ঠেলায় আমাদের সুবিধা যেমন হাজার পদের, অসুবিধাও খুব কম না! এই যে- আজকের দিনের ফেসবুকিয় ভাষা তো একেবারে বিশ্রি! যেনতেনভাবে আমরা লিখছি- যেকোনভাবে ভাবটা দেখাতে পারলেই হলো! তাতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে মুঠোফোনে দেয়া নানা কিছিমের বর্ণমালা-সম্ভার। মূলত আমাদের প্রিয় বাংলা দিনেদিনে সমৃদ্ধ হয়েছে নানা ভাষার ভান্ডার থেকে প্রয়োজনমাফিক শব্দ নিয়ে। অবশ্য পৃথিবীর যেকোন দেশ তার সংস্কৃতি-ভাষাকে বলবান করে প্রয়োজনের নিরিখে, বিশ্ব গ্রাম ধারণায় এ প্রথাটি অন্যাবশ্যকও নয়। সেদিক দিয়ে নেয়ার সুবিধা যেমন আছে, দেউলিয়া হওয়ার ইতিহাসও কিন্তু একেবারে কম নয়। আকাশ-সংস্কৃতির চরম গ্রাসে পুঁজিবাদি ব্যবস্থার হুজুগে অনায়াসে ঢুকে পড়ে অবাঞ্চিত বিষাশয়টুকুও। তবে যারা, বোঝে বাস্তবতার স্বরূপ, তারা সমুখের পথকে চিনে নিয়ে- সময়কে ধারন করে এবং যাপিত জীবনের নানা অনুষঙ্গের সাথে বাঁচিয়ে রাখে প্রাণের ভাষাও।
এতে অভ্যস্থ হতে না পারার বেদনা বিরাট, বিপুল বোঝা নিতে উদাহরণ হতে হয় সমুখের ইতিহাসচর্চায়। লোকপ্রচলিত অনেক ভাষাই হারিয়ে যাচ্ছে অব্যবহৃত হবার যন্ত্রণায়, ভাষা-গবেষকেরা তার ফসিল দেখিয়ে অন্যদের ভয় দেখায়- আদপে ভয়ের কাজ নয় বরং জয়ের কাজই হতে পারে ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখাটা। আমরা হয়তো আশাবাদি হতে পারি- আমাদের দেশে জনসংখ্যা তো দিনদিন হুহু করে বাড়ছে, বিশ্ব ব্যাপি বাড়ছে বাঙালির সংখ্যা; সুতারাং আমাদের নাই হবার সম্ভাবনা একেবারেই নাই। তা হতে পরে না- বিশেষ করে আমাদের প্রজন্মের দৈনন্দিনের ভাষাকে কোনভাবেই ভাষাপ্রেমের নমুনায় ফেলা যায় না। আমরা ভাষার জন্য রক্ত দেয়া জাতি বলে যে চেতনা লোকমুখে দেখাই তা-ই যদি ভেতরকার দর্শন হয়, তো মাথার তাজ কিন্তু রক্তাভ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যার জন্ম-উত্থান-প্রসার তার জন্যে চাই আলাদা কিছু।
বলাবাহুল্য আমরা ফেনা তুলতে প্রস্তত, বানান ভুলে পাঠ্যপুস্তক কিংবা বিজ্ঞাপনবিল তুলতে পারি আবার সেটা নিয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে ভুল বানানটিই ভুল করে থাকি! আসলে আমাদের শংকর-মানসে ভর করে থাকে বাচ্চাকাচ্চাসহ মামদোভ‚ত!
ভাষা-বিষয়ক ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে আমরা প্রায়ই কথা বলি, দরদ দেখাই কিন্তু ফেব্রæয়ারি চলে গেলেই তো ভুলে যাই চেতনতাজাত কর্তব্যের কথা! আমাদের সবকিছুই কি তবে অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে? একুশ তারিখের পর খুব একটা কথা বলি না মায়ের ভাষা নিয়ে। শিক্ষবর্ষ শেষ হলে কি করে ছেলেকে ইংরেজি শিক্ষাকেন্দ্রে ভর্তি করা যায় তা নিয়ে ভাবি, অর্থের অনৈতিক লেনদেন করি এবং দিনশেষে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি এই ভেবে- আমার সন্তান পড়ে অমুক বিদ্যায়তনে! যুগের প্রয়োজনকে অস্বীকার করবার স্পর্ধা বলতে গেলে সামাজিক মানুষের থাকে না, নানামুখি হাত-পা নিয়ে সে বাঁধা থাকে তারই বলয়ে কিন্তু যুগের কাজি দ্বীন মুহাম্মদ স্যার নেই যে বানানের শুদ্ধি অভিযান চালাবেন!
ফলত, সামনে আসে লেখকদের ভ‚মিকার কথাটুকুও। যুগে যুগে লেখকেরা তো ভাষার সেবা করে যান বিনা স্বার্থে, বিনা অজুহাতে। শাহ মুহাম্মদ ছগিরের সে ঐতিহাসিক কবিতা কখন লেখা? হয়তো আমাদেরই বন্ধু-ভাই-পরিজনেরা যখন উর্দু-সংস্কৃত বা অন্যান্য ভাষা নিয়ে ব্যস্ত তখনই তার এ ঘোষণা জাগিয়ে দিয়ে যায় রীতিমতো। তারও পরে, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের নাম বিস্মৃত হওয়া মানে বড়ো রকমের অপরাধ করার কাতারেই পড়ে।
পাকিস্তানি শাসকদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ক্রমাগত মাতৃভাষার স্বপক্ষে বিবৃতি-বক্তৃতা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনায় নিজের জীবনকে স্বার্থক করেছেন- তখন হয়তো আজকের মতো চেতনাজাত ব্যবসায়িক চিন্তাপুঞ্জ ছিল না, ছিল মা-মাটির প্রতি দায়বদ্ধতা। অনেকেই, ভাষাদিবস আসলেই, ফাগুন মাসের কথা বলেন, তা আসলে ভাববার আগে বাস্তবতাকে ধারণ করা দরকার। যেখানে আমাদের দেশের আদালত সমূহ রায় ঘোষণা করেন ইংরেজিতে, কৃষকেরা আর বাংলা মাসের হিসেব রাখেন না- সেখানে বাংলা পঞ্জিকা অনুসরণের ইতিবাচকতা কতটুকু তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। বৃটিশেরা আমাদের মাথায় তাদের শিক্ষাব্যবস্থা-আইনকানুন ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে সুচতুরতার সাথে, বর্তমানে বিভিন্ন সংগঠনও করে যাচ্ছে- আমাদের দেশিয় বীজ নিয়ে দিচ্ছে নানাজাতের বিদেশি বীজ; ফলে বাংলা মাসের দিনতারিখ অনুসরণ করবার সুযোগ ব্যাপকহারে সংকোচিত হয়ে যাচ্ছে।
আমাদের দৃষ্টিবান নেতাদের- বিশেষ করে যারা শিল্প-সংস্কৃতির পথে নিয়োজিত তারা বাংলা ভাষার ব্যাপকতাকে কীভাবে বিশ্ব ব্যাপি ছড়িয়ে দেয়া যায় সে বিষয়ে অনুসন্ধান করা। হানা টমসন, মারিয়া হেলেন বেরা, ক্লিনটন কি সিলি প্রমুখ বিদেশীরা এমনে এমনে বাংলা ভাষার প্রেমে পড়েন ন- তারা এ ভাষার রূপমাধুরিতে উৎফুল্ল, ভেতকার সৌন্দর্যে আন্দোলিত।
আমাদের যারা রাষ্ট্রপরিচালনা বা রাষ্ট্রীয় এসব দফতর দেখেন তারা চাইলে বিদেশীদের বাংলা ভাষা চর্চা ও গবেষণার বিষয়টিকে সম্প্রসারিত করতে পারেন- তাতে আমাদের ভাষার সৌন্দর্য যেমন বিশ্ব ব্যাপি টিকরে পড়বে তেমনি আরো অনেকেই উদ্বুদ্ধ হবেন বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করতে। ভাষার মাস, বইমেলার মাস বলে খ্যাত ফেব্রুয়ারিতে সারাদেশেই বইমেলা ও এ-জাতীয় নানা আয়োজন দৃশ্যমান হয়। লেখক-পাঠকেরা অপেক্ষা করেন নতুন বই দেখবার-পড়বার এবং জানবার। কিন্তু অনেক বিশ্লেষক তো মুখের উপরেই বলে দেন মানহীন বই প্রকাশের কথা, ভুল বানানে বই প্রকাশের কথা। যেহেতু বইয়েই ভাষা লুকিয়ে থাকে তার যাবতীয় গুপ্তধন নিয়ে, আমাদের আরো মনোযোগি হওয়া উচিত। লেখকেরা চেষ্টা করে যান নিরন্তর, কেউ পাঠকের- সমগ্র ভাষা অনুসারিদের মানোস-আকাক্সক্ষাকে ফুটিয়ে তুলতে পারেন কেউবা ব্যর্থ হন। ব্যর্থ হওয়া অন্যায় নয়, তবে মাতৃভাষা নিয়ে ছেলেমি করা অবশ্যই দোষের। কেননা, পাঠের পর যে অনুভ‚তি তা পবিত্র, প্রভাব ফেলে বাস্তব জীবনের নানা ক্ষেত্রে।
বাংলা ভাষার শত্র মিত্র নামে হুমায়ুন আজাদ মহোদয়ের বিখ্যাত বই আমরা দেখি বিভিন্ন বই বিপনিকেন্দ্রে। কিন্তু এই সময়ে, আজকের দিনে বাংলা ভাষার শত্রু কারা? এরকম প্রশ্নে অনেকেই ভ্যাবাচ্যাক খেলেও একেবারে অবাস্তব নয় এটা অবতারণা। উর্দু না হয় ইসলামাবাদে উড়ে গেছে, চলে গেছে শিকড়বাকড়সহ। কিন্তু হিন্দির যে দোর্দন্ড প্রতাপ তা কী দিয়ে রুখা যাবে? আমাদের মায়েরা-মেয়েরা হিন্দি নাটকে যেভাবে আসক্ত হচ্ছেন তার তাৎক্ষণিক ফলাফলে আর কিছু না পাই অন্দরে হিন্দি ভাষা চর্চার হিড়িক দেখতে পাওয়া যায়। কম বয়েসি বাচ্চারা হিন্দি বলতে চেষ্টা করছে, করছেও অহরহ। ইংরেজি আগে থেকেই আছে কিন্তু বিষয়টার প্রাতিষ্ঠানিক একটা ভিত্তি তো আছে! আমরা হিন্দি শিখবো, প্রতিবেশির অনেক গুন-দোষ নিজ ঘরে আসাটা স্বাভাবিকও বটে- তাই বলে যে শিশুটির মুখ-ফোটার সাথে সাথেই হিন্দি বুলিতে বোঝাতে চায় দৈনন্দিনতা তা ভবিষ্যতের জন্যে মারাত্মক হুমকি হয়েই থাকবে।
আমরা সব ভাষা থেকে প্রয়োজনমাফিক শব্দ নেবো, নিজেদের ভাষাকে সমৃদ্ধ করবার জন্যে- তাতে যদি দেউলিয়া হওয়ার সম্ভাবনা জেগে উঠে তো ভয়াবহ! বক্তৃতা দেয়া সহজ, সমালোচনা করাও- পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপান্তর করা আসলেই কঠিন। জব্বার-শফিক-রফিকদের রক্তের ঋণ কিছুটা যদি এতেই শোধ করা যায় খারাপ কিসে!সবচেয়ে আনন্দের বিষয় আমাদের সাহিত্যকর্মি, ছোটকাগজকর্মি কিংবা দৈনিকগুলোর ভাষাপ্রীতি অত্যন্ত উঁচু দরের। অন্তত ভাষার মাস আসলেই নানা রকম সংখ্যা হয়, বিশেষ সংখ্যা হয়। এ সমস্ত আয়োজন আর কিছু করতো না পারুক- আমাদের মতো হুজুগে জাতিকে ভাবাতে সাহায্য করে, চর্চা করার সুযোগ উন্মেচিত করে, একটু পেছনের দিকে দৃষ্টি দিতে বাধ্য করে।
আরো মজার ব্যাপার তরুণেরদের বৃহৎ একটি অংশ ভাষা নিয়ে চিন্তা করে, নতুন নতুন সাহিত্যকর্ম সৃষ্টির মাধ্যমে, নতুন নাটক বানাবার মাধ্যমে, ছবি আঁকার মাধ্যমে মায়ের ভাষাকে তুলে ধরতে চেষ্টা করে প্রাণপণে। নান নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে তারা ভাষার অবদানকে বিশ্ব মঞ্চে উপস্থাপিত করছে নতুন ব্যঞ্জনায়। একটি নতুন চলচ্চিত্র যখন বিশ্ব মঞ্চে স্বীকৃতি পায়, একজন শিল্পী যখন বিদেশে থেকেও হাতের তুলিতে আঁকে নিজদেশের পাতাকার আদল, কেউ উড়ায় এভারেস্টে উড়ায় বাংলাদেশের পতাকা- তাও মায়ের ভাষায়, আমরা পেরেছি বলে, সত্যিই আনন্দিত হতে হয়।
কে না জানে আজকে অর্জনের পেছনে আছে মাতৃভাষা হিসেবে বাংলার নিজস্বতা অর্জনের ইতিহাস। হয়তো উপরতলার মানুষদের কাছে মাতৃভাষা বাংলা উপেক্ষা করবার মতোন কিন্তু নিচুতলার মাটির মানুষেরা এখনো পায়ে যদি কোন বইয়ের ছেঁড়াপৃষ্টা পড়ে তো তিনবার কপালে-বুকে লাগায়, সালাম দেয়, প্রাণের প্রণতি জানায়। আদাব-সালামের জায়গায় প্রিয় ভাষাটি যতদিন থাকবে ততদিন কি এ-ভাষাটি হারিয়ে যেতে পারে?
...................................................................................
## সমাপ্ত ##
কোন মন্তব্য নেই