Header Ads

বিদগ্ধ যন্ত্রনা


 বিদগ্ধ যন্ত্রনা


সাগরের বুক চিরে আচড়ে পড়া ঢেউ গুলো এলোমেলো ভাবনায় টালমাটাল করে দিচ্ছে মনের ভাবনাগুলোকে। লুবনা কিছুতেই যেন স্থির হতে পারছিল না। সামুদ্রিক গর্জন আর বিশাল বিশাল ঢেউ এসে লুবনার মনটাকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছিল বারবার। মনের ভেতর কোন মন্দলাগা বাসা বাঁধলেই লুবনা ছুটে আসে সমুদ্রের কিনারায়। আপন মনে আচড়ে পড়া ঢেউয়ের সাথে কখন যে তার নিবিড় একটা সখ্যতা তৈরি হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি সে।  সাগরের কোল ঘেষে আসন পেতে থাকা একটি দোকানে বসে সাগরের সৌন্দর্য উপভোগ করছিলো লুবনা।

বিচের এ দোকানের লোকজন বেশ ভাল চেনে তাকে এবং যতক্ষণ লুবনা এখানে থাকে তারা অন্যরকম একটা প্রটেকশন দেয় লুবনাকে- আর  দেবেই না বা কেন? লুবনার মিষ্ট ভাষায় যে কোন মানুষই মুগ্ধ হয়ে যায় অনায়াসেই, অত্যন্ত রূপ লাবন্যে ভরা তার ব্যক্তিত্ব। সাগরের অস্থিরতার সাথে লুবনার কাজল দুটি চোখের অস্থিরতা হেলাল চাচার দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। হেলাল চাচা- বিচের এই দোকানটার মালিক, খুবই পছন্দ করেন লুবনা কে, মেয়ের মতো স্নেহের বন্ধনে আগলে রাখেন লুবনাকে যতক্ষণ লুবনা এ বিচে থাকে। বাবা না হলেও বাবার মতো তো, তাই লুবনার কাজল চোখের টলটল জল, মলীন চেহারা সবই হেলাল চাচার কাছে স্পষ্ট। লুবনার কাছে এসে হেলাল চাচা বসলেন মুখোমুখি লুবনার চেয়ারের সামনে, ‘কিরে মা, আবার কি হলো?’ 

হেলাল চাচার কথায় অন্যমনষ্ক লুবনা বেশ চমকে গেল- ‘আজ আর কিছু জিজ্ঞেস কোর না চাচা, তুমিতো সবই জানো, তবে এই মুর্হুতে আজ আর কিছুই বলতে পার না তোমায়, আমায় ভুল বোঝনা প্লিজ চাচা।’ লুবনা হেলাল চাচার হাত ধরে করুন এ মিনতি করল।

‘ঠিক আছে এক্ষুনি আমারে কিছুই কইতে হইব না, তয় আমার একখান শর্ত আছে আমি অহনি ফ্রাইড নুডুলস, পিয়াজু নামায় আইলাম- হেইডা এক্ষুনি আমার সামনে খাইবা, আমি নিজে কড়া কইরা কফি বানাইয়া আনতাছি- যদি তুমি খাও তাইলে তো ঠিক আছে, আর যদি না খাও তাইলে অহনি আমি দোকান বন্ধ করুম, আর খুলুম না তুমি আমারে বিচরাইয়াও পাইবানা- চেহারার কি অবস্থা  করেছো, সকাল থিক্কা যে পেটে দানা-পানি পরে নাই হেইডা আমি খুব ভাল কইরা বুঝতাছি।’

গড়গড়িয়ে কথাগুলো লুবনাকে বললেন হেলাল চাচা। এক যুগেরও বেশি হলো লুবনা ও হেলাল চাচার সম্পর্ক। লুবনার বাবা-মা কেউ নেই। বড় ভাই ভাবীর সংসারেই তার বেড়ে ওঠা এবং অনেক কিছু। লুবনা নিজের বাবার মতোই শ্রদ্ধা করে হেলাল চাচাকে। হেলাল চাচার কোন কথাই সে কখনো ফেলেনি আর তাই এখানেও অবাধ্য হবার কিছুই নেই। হেলাল চাচা দোকানের ছেলে রতনের হাতে নাস্তা পাঠালেন আর নিজে বানাচ্ছেন লুবনার জন্য স্পেশাল কফি।

হেলাল চাচার দোকানে মোট ছয় জন কর্মচারী, সবই লুবনা বলতে অজ্ঞান। রতন নাস্তা দিয়ে বললো, ‘আফা জলদি খান, আপনে অমনে থাকলে আমাগো কারো যে কিচ্ছু ভালোলাগে না, এইডা আপনে বুঝেন না? আমাগো ওস্তাদ কইছে আপনার লাইগ্যা আপনার পছন্দের কাচ্চি বিরানী চুলায় দিতে, প্যাকেট কইরা দিমু বাসায় যাইয়া অগো লইয়া আয়েশ কইরা খাইবেন। এই লাইগ্যা অহন আর আমার হাতে টাইম নাই আপনে এইডা জলদি খান, ওস্তাদ কফি লইয়া আইতাছে।’

লুবনা চোখ মুছতে মুছতে বলল, ‘তোদের এই ভালোবাসার জন্যই হয়ত আমি এখনো বেঁচে আছি। কেন এতো মায়ার ডোরে আবদ্ধ করছিস্ আমায়?’

‘আফা আপনে আমাগো এই ছয়টা এতিম পোলারে যেই ভ'ালোবাসা দিছেন, এই দোকানের জন্য যা করছেন, আমাগো ওস্তাদরে যেই সাহায্য সহযোগিতা করছেন, করতাছেন হেই তুলনায় আমরা হারা জীবন চাইলেও আপনার লাইগ্যা কিছুই করতে পারুম না শুধু ভালবাসা ছাড়া।’

রতনের এসব কথায় অবাক হয়ে গেল লুবনা। দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলল, ‘এই ভালোবাসারই বড় আকাল আমার জীবনে। আমি যে এই ভালোবাসারই কাঙাল।’

রতন চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল। দোকানের সবার মন রাখতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও লুবনা নাস্তা করল, অল্প সল্প করে। হেলাল চাচা ব্যস্ত গ্রাহকের আনা গোনায়। সবার খুব পছন্দের এই দোকানাটা, কারণ এখানকার খাবার যেমন সু-স্বাদু, তেমনি স্বাস্থ্যসম্মত বললে ভুল হবে না। বিচের সবচেয়ে সুন্দর দোকান হলো হেলাল চাচার এই দোকানটা, আর তাই গ্রাহকের কমতি থাকেনা কখনোই। ইতিমধ্যে লুবনার হাতে স্পেশাল কফি চলে এসেছে, হেলাল চাচা নিজে দিয়ে গেছেন। কফি হাতে সাগরের উত্তাল হাওয়ায় ক্রমেই লুবনা বারবার ফিরে যাচ্ছিল অতীতের সেই দুঃসহ যন্ত্রনার গহীন অন্ধকারে। কেন এমন হলো ওর জীবনটা। কেন এ ছিনিমিনি খেলা খেললো জীবন তাকে নিয়ে। লুবনা কফিতে চুমুক দিচ্ছে আর ভাবছে এসব সময়ের কথা।


তিন বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার চেয়ে ছোট লুবনা। সবার খুব আদরের পাত্রী। লুবনার বয়স যখন আট বছর, তখনি এক প্লেন ক্রাশে মারা যায় লুবনার বাবা-মা। তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণ করতেন, পড়ার ক্ষতি হবে বলে বাচ্চাদের সব সময় সাথে নিতেন না। আর তা ছাড়া লুবনার বাবা প্রায়শই বলতেন, ওদের জীবন ওরা উপভোগ করবে যখন ওদের সময় হবে। আজ আমাদের সময়, কেননা প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী আমরা যাচ্ছি পেছনে আর বাচ্চারা যাচ্ছে সামনে, তাই আমরা আমাদের জন্য ওদের পড়াশুনা কেন বিঘœ করব। লুবনার বাবার এ কথা প্রায় বলেন  লুবনার মামা আর কাঁদেন। খালা-মামার স্নেহেই বড় হয়েছে লুবনারা।

লুবনার বড় ভাই- ভাবী দুজনই ডাক্তার, ডেন্টিস্ট, মেজ ভাই শিল্পপতি, ভাবী সমাজসেবিকা, আর ছোট ভাই-ভাবী ঢাকা ভার্সিটির লেকচারার বর্তমানে পিএইচডি করতে অস্ট্রেলিয়ায় আছে। বড় দু’বোন কানাডায় সেটেল। লুবনা মাঝে মধ্যেই সময় পেলে বোনদের কাছে বেড়িয়ে আসে। লুবনা মাস্টার্স করেছে বাংলা সাহিত্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ভাই-বোনদের আদর আহ্লাদের বিন্দুমাত্র অভাব ছিল না ওর জীবনে। ভাবী কিংবা দুলাভাইরা পারলে আকাশের চাঁদটাও যেন ওর হাতে এনে দেয়। সবই ঠিক ছিলো, হাসি খুশি ভরা একটি সুখী পরিবার ছিল। লুবনার বড় ভাই লুবনা মেমোরিয়াল ট্রাষ্ট নামে একটি বিশাল হাসপাতাল করেছেন, সেই হাসপাতালের সব কিছু লুবনার নামে। ওদিকে লুবনার মেজভাই বিশাল একটি সোয়েটার ফ্যাক্টরী লুবনাকে উইল করে দিয়েছেন। আর বাড়ি তো ওদের সব ভাই-বোনদের নামে ওর বাবা-মা বেঁচে থাকতেই করেছেন। গ্রামে রয়েছে হাজার একর জায়গা যার জন্য  কেয়ারটেকার রাখা হয়েছে দেখা শুনা করার জন্য। অর্থাৎ বাড়ি ব্যাংক ব্যালেন্স সবই যেন চাহিদার শতগুণ বেশি ছিল। ভাবনাহীন জীবন যাচ্ছিল লুবনার। হঠাৎ একদিন লুবনার বড় বোন লুবনার বিয়ের প্রস্তাব আনে, সুদূর কানাডায় থাকে ছেলে। লুবনাকে কানাডাতে দেখেই পছন্দ করেছিল। লুবনার বড় বোনরা ছেলেকে ভালো করেই চেনে ও জানে বলে দাবী করেছিল। লুবনা এবং বড় ভাবীর এ বিয়েতে মত ছিল না। লুবনা চাচ্ছিল মাত্র পরীক্ষা শেষ হলো রেজাল্ট দেখে তারপর কিছু একটা চিন্তা-ভাবনা করবো। তাছাড়া সেই ছেলে অর্থাৎ রাজীব যার চলন-বলন তেমন একটা কিছুই ভাল লাগেনি লুবনার। কিন্তু বোনদের জিদ তাদের ইচ্ছা ছোট বোনটা তাদের নজরে নজরে থাকবে। আর তাই কোন কিছু বোঝার আগেই বিয়েতে মত দিতে হল লুবনাকে।

বিয়ের দিন বধু সাজে যেন ডানাকাটা পরী মনে হচ্ছিল লুবনাকে। যেহেতু ছেলে কানাডা থেকে এসেছে তাই বিয়েটা লুবনাদের বাসাই চট্টগ্রামে হয়েছে। আর লুবনার নিজ এ্যাপার্টমেন্ট ভাইদের এ্যাপার্টমেন্টের সামনে তাই সামনা-সামনি হলো বিয়ে এবং বিদায়। 

সবাই খুশি, লুবনা খুশি থাকার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু শাক দিয়ে মাছ কতক্ষণই বা ঢেকে রাখা যায়। অসহনীয় কষ্ট দেখতে দেখতে লুবনা পার করলো বিয়ের চারটি মাস। রাজীব লুবনাকে ব্যবহার করতে লাগল বাবার কেনা সম্পত্তির মত। তাতে কোথাও কোন শ্রদ্ধা ছিল না, ছিল না সামান্যতম ভালোবাসা। সে অপদার্থের মত শ্বশুর বাড়িতে বসে থাকছে, খাচ্ছে, মদ আর জুয়া খেলে দু’হাতে লুটিয়ে বেড়াচ্ছে টাকা-পয়সা। সহ্যের সীমা পেরিয়ে লুবনা যখন এসবের প্রতিবাদ করলো সে যা করছে এগুলো অন্যায় বোঝাতে চাইল, আর তখনি সে শুরু করল আরও বেশি অমানুষিক নির্যাতন। লুবনা তাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে- ‘তুমিতো বলেছিলে, বিয়ের দু’একদিন পরেই আমাকে কানাডা নিয়ে যাবে- তোমার ওখানে মাল্টিপল ব্যবসা। আজ প্রায় চার মাস হয়ে গেল, তুমিতো কানাডা যাবার নামই নিচ্ছ না, এটার মানে কি?’ 

রাজীবের অকথ্য ভাষা, ‘তুই আর তোর পরিবারের সবাই পাগল, তোর বোনরা হইলো মহা পাগল। আরে কানাডায় যেই দোকানে আমি সেল্সম্যান ছিলাম তোর বোনরা মনে করছে ওইটা আমার নিজের শপিংমল আর আমিও তাদেরকে সোজা পাইয়া ইচ্ছা মতো ভাল ছেলের অভিনয় কইরা গেলাম, তারা যেন আমার অভিনয় ধরতে না পারে হেইজন্য তোর বোনের পাশের ফ্লাটের আমার এক বন্ধুর বোনরে খালাত বোন বইলা তোর বোনদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। আমার ঐ বন্ধুর বোনের অবস্থা তোর বোনদের অবস্থার মতো। তারে আমি তার বাচ্চা দিয়া ব্লাকমেইল করছি- তাই সে কাঠের পুতুলের মত আমি যা বলছি তাই বলছে। তোর বোনরা কিছুই বুঝতে পারে নাই। এক একদিন এক এক বন্ধুর গাড়ি নিয়া তোর বোনদের সাথে দেখা করতাম। এতে আমারও বেশ মাল-পানি খরচ করতে হইছে। তবুও আমি একটা আশায় আশায় খরচ করছি যে, একদিন এর দ্বিগুণ আমি তুইলা নিমু। আর তোরে যেই দিন প্রথম দেখেছিলাম সেইদিনই তোরে মনে ধরছিলো- প্রতিরাতে স্বপ্নে তোরে লইয়া... হি হি!’

এসব শুনে মাথায় আকাশ ভাঙার মতো তীব্র যন্ত্রণা অনুভূত হল লুবনার। ঘৃণায় মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল বারবার। চিৎকারও করতে পারছিলনা! শুধু বিড়বিড় করে বলতে  লাগল - আপারে এ তোরা কি করলি? কি করলি? 

লুবনা চোখ মুছে আবারও দাঁড়াল, আবার, মিনতি করতে লাগল রাজীবের পাষান্ড ঐ হৃদয়ের কাছে, ‘ঠিক আছে তুমি যদি আমায় সারাজীবন নির্যাতন করবে বলে স্থির করেছো, বেশ তাই হবে, তবে এখানে নয়, চলো আমায় নিয়ে কানাডা চলো, তুমি যা বলবে, যেভাবে বলবে আমি তাই করব, প্লিজ এখান থেকে চলো আমার ভাই ভাবীরা জানলে তারা কষ্টে মরে যাবে, আমি তাদের কষ্ট দিতে চাইনা, আমি আমাকে নিয়ে তাদেরকে কোন দুঃশ্চিন্তায় ফেলতে চাইনা-প্লিজ চলো।’

কথাগুলো শেষ করতে না করতেই রাজীব লুবনার চুলের মুঠি ধরে দেয়ালে বাড়ি দিল, ‘ওই তুই পাগল হইসোছ, আমি এতো আরাম-আয়েশ ছাইড়া ঐ গাধার খাটুনী খাটতে যামু?’

অমানুষের মত চড় মারল ওর গালে, গলা চিপে ধরে বলল, ‘যেভাবে আছোস এইভাবে না থাকলে, আমার কথা মত না চললে, তোর পুরো শরীর আমি এসিড দিয়া পুড়াইয়া দিমু-তখন তোর এই রূপ কুত্তা বিলাইও চাটবোনা।’

নেশায় জর্জরিত রাজীব এসব অকথ্য গালাগাল করেই যাচ্ছিল- লুবনা কোন মতে রাজীবের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘আমি তোমার হাতের পুতুল হবো না।’

হঠাৎ বেজে উঠল লুবনার সেলফোন।

‘হ্যালো’ বলতেই লুবনার মেজবোন অপর প্রান্ত থেকে ‘হ্যালো লুবনা তুই কেমন আছিস। আপু, আপুরে তুই ভালো আছিস তো?’

লুবনা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আপু যে স্বর্গসুখের ঠিকানা তোমরা আমার জন্য খুঁজলে, তা যেন কখনো কেউ কারও শত্রুর জন্যও না খোঁজে, আপু আমি কি অপরাধ করেছি? আমি এখন কী করব?’

‘আমি বড় আপার কাছে সব শুনতে পেয়েছি, বড় আপা তোর টেনশনে বর্তমানে হাসপাতালে, আমাদের পাশের ফ্লাটের রাজীবের বোন পরিচয়ে যে মহিলা ছিল- সে সব বলেছে আপাকে, রাজীবের আসল চেহারা জানলাম পরশু দিন- ঐ ভদ্র মহিলার পাঁচ বছরের বাচ্চাকে জিম্মি করে রাজীব এগুলো নাটক করিয়েছে তাকে দিয়ে। সে কান্নাকাটি করেছে, দুঃখ প্রকাশ করেছে, বড় আপা পরশু দিন থেকেই হাসপাতালে, বড় আপা বারবার বলছে, আমি লুবনার জীবন নষ্ট করে দিলাম, আল্লাহ তুমি আমায় মৃত্যু দাও- মৃত্যু দাও.... লুবনা আপুরে আমরা তোকে কাছে পেতে যে তোর এত বড় সর্বনাশ করে ফেললাম। রাজীবের আসতে দেরী হচ্ছিল বলে বড় আপা ঐ ভদ্র মহিলাকে জিজ্ঞেস করতে  গিয়েছিলেন আপনার ভাই রাজীবকে তো ফোনেই পাচ্ছি না, আর কতদিন লাগবে কানাডায় আসতে, রাজীব বলেছিল আপনার মায়ের পাসপোর্ট সমস্যার কারণে দেরী হচ্ছে নাকি? তখন ঐ ভদ্রমহিলা বলেলন সব কথা- রাজীব আর কোনদিন আসবে না।’

‘আপু ভাইয়াকে কিছু জানিওনা, ভাইয়া মরে যাবে, আমি এক সপ্তাহের মধ্যে কানাডা চলে আসব- তুমি প্লিজ এ কটা দিন ভাইয়াকে ভাবীকে কিছু জানিও না-ভাইয়া মরে যাবে।’

অমনি কোমরে লাথি মেরে লুবনার হাত থেকে মোবাইল ছিটকে ফেলে দিল রাজীব- ‘তোর মোবাইল এই তিন মাসে আমি কয়টা ভাঙলাম, তোরে বলছি মোবাইল ব্যবহার করবি না, কই পাইলি মোবাইল তুই, তোর গুষ্টির এত খবরদারী কেন? তোর পাশে তোর ভাই ভাবীরে আমি বুঝতে দিলাম না আর কানাডা পার্টি আমার সব খেল এইভাবে নষ্ট করবে, এইডা আমি হইতে দিমু না- ইমপোসিবল!’ লুবনার পেটে লাথি মারছে আর বলছে, অমানুষ রাজীব।

লুবনা যন্ত্রণায় চিৎকার করছিল।

হ্যালো হ্যালো করেই যাচ্ছে লুবনার মেজবোন। লুবনার এ নির্যাতন সবই সে শুনলো। উঠে মোবাইল নেয়ার মত কোন শক্তি পেলনা লুবনা। জ্ঞান হারিয়ে ফেলল, আর যখন জ্ঞান ফিরলো তখন হাসপাতালে মুমূর্ষ অবস্থায় লুবনা। তাকে ঘিরে তার পরিবারের সবাই, লজ্জায় ঘৃণায় বারবার চোখ বন্ধ হয়ে আসছিলো লুবনার। ভাই-ভাবীদের কান্না দেখে নিজেকে আর কিছুতেই সামলাতে পারলো না লুবনা। ভাবী অনেকটা ধমকের সুরে বললেন, ‘এত নির্যাতন তোকে কে সহ্য করতে বলেছে? আমরা কি মরে গিয়েছিলাম? তোর ভাইরা তোকে কোনদিন ফুল দিয়ে টোকা দেয়নি, আর ওই জানোয়ারটা কি হাল করেছে? আমাদের কেন জানতেই দিলিনা? শরীরের এ ঘা ঢাকতেই তুই হিজাব, বোরকা পড়া শুরু করেছিলি? কত আশা নিয়ে তোর ভাই আমরা দেশে ফিরলাম তোদেরকে একে অপরকে বোঝার জন্য আমরা একটু কম সময় দিলাম, যাতে তোরা দু’জন দুজনকে ভাল করে বুঝতে পারিস- দু’মাস পরে দেশে ফিরে একি দেখতে হলো, একি জানতে হলো- গতকাল এয়ারপোর্টে দেখা হলো তাওতো কিছু জানালি না আমরা এত পর হয়ে গেলাম। ঐ লম্পটটা তোকে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে পালিয়েছে, আমাকে ফোন করেছিল, মেজআপা আর তাই তোর ওখানে যাই, ডাক্তার বলল, তোর মিসক্যারেজ হয়েছে।’

লুবনার বুকে হু হু করে ঝড় তুফান বইতে লাগল, কাঁদতে কাঁদতে আবার মুর্ছা গেল লুবনা। ভাই সঙগাহীন লুবনাকে নিজের কোলে শোয়ালেন, আর ছোট বাচ্চার মত কাঁঁদতে লাগলেন লুবনাকে জড়িয়ে ধরে। প্রায় তিন ঘণ্টা পর জ্ঞান ফিরল লুবনার। ভাইয়ের কোলে নিজেকে দেখে আবেগে আরও বেশি আপ্লুত হয়ে গেল লুবনা। লুবনার ভাইরা রাজীবকে পুলিশের কাছে তুলে দেয়। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে হাসপাতালে আনলো লুবনার স্টেটমেন্ট নিল এবং রাজীবকে দেখাল তার বর্বরতার করুণ চিত্র। পুলিশ জানাল রাজীবকে তারা অনেক দিন যাবত খুঁজছিল- রাজীব একজন আন্ডারগ্রাউন্ড স্মাগলার। পুলিশ রিমান্ডে নিয়েছে রাজীবকে।

সুস্থ হয়ে যখন বাসায় ফিরল তখন নিজের এ রূপ টাকা-ব্যাংক-ব্যালেন্স সবই যেন অসহ্য মনে হচ্ছিলো লুবনার কাছে। আয়নায় দাঁড়িয়ে বারবার বলছে, কেন আমি এত অসাধারণ হলাম, কেন? কেন?


 সময় তার নিজের গতিতে বহমান নিঃসঙ্গতা নিয়ে এক এক করে লুবনা কাটিয়ে দিল দু’টি বছর। দুঃসহ অতীত আর লুবনা ভাবীর পীড়াপিড়িতে লেকচারার হিসেবে লুবনা জয়েন্ট করল চিটাগাং ইউনিভার্সিটিতে। ভাবী চিন্তা করল যদি কোন কিছু দিয়ে লুবনাকে ব্যস্ত করা যায় তাহলে দূর হবে ওর একাকিত্ব। হয়তো কিছুটা হলেও দূর হবে ওর কষ্টের তীব্রতা একটু হলেও যদি হাসি ফোটে লুবনার মলীন মুখটায়... ভাবীর খুশির জন্য লুবনা চেষ্টা করল সহজ হতে। ভাই ভাবী তথা পরিবারের সবাই খুবই চিন্তিত লুবনাকে নিয়ে। লুবনার জীবন নষ্ট করেছে এ অপরাধ বোধে স্ট্রোক করে মারা গেল লুবনার বড় আপা কানাডাতেই, মেজ বোনটাও নির্বাক হয়ে গেছে বোনের শোকে। সেও হাসপাতালে ভর্তি অতিরিক্ত মানসিক চাপে মেজবোনের শরীরের এক পাশ প্যারালাইসিস হয়ে গেছে- থেরাপি চলছে তবে কোন আশার কথা শোনায়নি কানাডিয়ান ডাক্তাররা। একটা ঘটনা, একটা মানুষ পুরো পরিবারটাকে তছনছ করে দিল। মেজভাই, ছোটভাই ভাবীরা রাগ করে আর যোগাযোগ করে না, তাদের ধারণা সব কিছুর জন্য ভাই ভাবী দায়ী- কেন একটু খোঁজ নিল না, কানাডা কি মানচিত্রের বাইরের কোন দেশ ছিল? লুবনার করুণ চেহারা যতবার দেখে ততবার এ নিয়ে পরিবারে তর্ক যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। পরিবারের বন্ধনের ভিতটুকু নড়ে গেল সব যেন ওলোট-পালট হয়ে গেল। 

সাগরের কাছে দাঁড়িয়ে আনমনে ভেবেই চলেছে লুবনা তার দুঃসহ অতীতের কথা। ভার্সিটি, সাগর আর বাসা এই তিনে ছিল লুবনার জীবন। ইতিমধ্যে হেলাল চাচা আসল, লুবনা শুধু বলল বাসার সবাই আবার ওর বিয়ে নিয়ে ভাবছে, তাই মনটা ভালো নেই। কিছুক্ষণ হেলাল চাচার সাথে কথা বলে ফিরে এলো লুবনা আবার বাসায়।


সব থাকলেও নিজের করে একান্ত আপন করে প্রয়োজন হয় একান্ত কোন আপনজন। লুবনার জন্য সবার একই চিন্তা কি করে ওর মুখে একটু হাসি ফোটানো যায়, দূর করা যায় ওর একাকিত্ব। বড় ভাই খুবই অসুস্থ শারীরিক মানসিক সবক্ষেত্রে ভেঙ্গে পড়েছেন তিনি, এই দু’বছরে একবারও বিজনেস ট্যুরে যাননি, প্রতি মাসে একদিন হলেও যান। কেমন যেন খাপছাড়া হয়ে গেছেন। শুয়ে বিড়বিড় করে বলেন, ‘এমন কি কোন ইরেজার এ পৃথিবীতে নাই যা দিয়ে লুবনার জীবনে ঘটে যাওয়া এ দূর্বিসহ অধ্যায়টি মুছে ফেলা যায় চিরতরে?’ 

খুব বেশি ইমোশনাল হয়ে গেছে লুবনার ভাই- আর তাই তিনি স্ত্রী কাছে এ করুণ জিজ্ঞাসা বারবার করেন, লুবনার ভাবী চোখ মুছেন আর বলেন, ‘শোন, জামানকে তোমার কেমন লাগে? ওতো আট-দশ বার আমাকে রিকোয়েস্ট করেছে লুবনার জন্য, তাছাড়া লুবনার সব সমস্যাই জামান জানে। লুবনাকেও দেখেছি ওর সাথে কথাবার্তা বলতে, কালও জামান অনেকক্ষণ লুবনার সাথে গল্প সল্প করে গেল, লুবনাকেও বেশ স্বাভাবিক লেগেছে।’

লুবনার ভাই হকচকিয়ে বললেন, ‘কি বলো আমাকে আগে বলবে না? এতো বেশ ভাল কথা, তাছাড়া দেখতে শুনতেও ছেলেটা চমৎকার তাহলে লুবনার সাথে আলাপ করা যায় কি বলো?’

লুবনার  ভাই ছুটে গেলেন লুবনার এ্যাপার্টমেন্টে সাথে ভাবীও। যেয়ে দেখেন, লুবনা বেলকনিতে ইজি চেয়ারে ঘুমিয়ে, ভাবী-ভাই লুবনার মাথা শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে লাগলেন। জ্বর হয়নি তো, শরীর খারাপ নেই লুবনার? লুবনা লাফিয়ে উঠলো।

‘আরে তোমরা এ সময়? নানা আমি ঠিক আছি-চলো চলো ভিতরে বসি।’

‘আপু তুই ভালো আছিস তো?’ বুকে জড়িয়ে লুবনার মাথায় হাত বুলিয়ে ভাইয়ের এ আকুল জিজ্ঞাসা লুবনাকে বেশ আবেগে আপ্লুত করে তোলে।

‘ভাইয়া তুমি আমার কথা ভেবে নিজেকে এভাবে আর কষ্ট দিওনাতো আমি এইতো বেশ আছি। ভাবী ভাইয়াকে তুমি বোঝাওনা কেন? কেন ভাইয়া ঠিক মত অফিসে যাচ্ছে না? বিজনেস ট্যুর করছেন না, এমন কি পার্টিতেও এটেন্ড করছেনা। সব কিছুর জন্য আমিই দায়ী তাই না ভাবী, তাই না ভাইয়া?’ অনর্গল নিজেকে দোষ দিয়ে বলে চলল লুবনা।

ভাবী লুবনাকে শান্ত হতে বলল, ‘তুমি কোন কিছুর জন্য দায়ী না। আমরা যা করি মন থেকে করি, মনটাই যখন ভালো থাকেনা, তখন আর কি ব্যবসা- কী পার্টি। তাছাড়া আমাদের কারও কিছু হলে তুমি কি স্বাভাবিক থাকতে পারতে লুবনা?’

লুবনাকে বুকে নিয়ে এসব কথা বলে চললেন  লুবনার ভাবী। লুবনার ভাই পরিবেশটাকে স্বাভাবিক করার জন্য কিছুটা মুডিয়াল এটিচিডউ ধারণ করে  বললেন, ‘আচ্ছা যে জন্য আমি এসেছি তাইতো বলা হলোনা। লুবনা, জামানকে তোর কেমন লাগে?’

লুবনা রীতিমত হকচকিত, ‘হঠাৎ জামান কেন ভাইয়া?’

‘লুবনা জামানকে তোর কেমন লাগে? আমিতো খুব একটা কথা বলিনি, তোর ভাবী বেশ প্রশংসা করছিল-ভাবলাম তোর সাথে তো ভালো জানা শুনা তোর কোন বান্ধবীর কাজিন নাকি?’

‘ভাইয়া প্লিজ বি কুল, এতো অস্থির হয়োনা আমার বান্ধবী বলতে আমার কলিগ রুবীর পরিচিত খুব ভালো জানা শুনা নাই, বলতে পারো চিনি কিন্তু জানি না, জামান হচ্ছে রুবী, মানে আমার কলিগের মামাত ভাইয়ের বন্ধু। রুবীর মামাত ভাইয়ের সাথে রুবীর এনগেজম্যান্ট হয়ে আছে- আর সেই সুবাদে রুবীর মামাত ভাই আর জামান প্রায়ই আসে ভার্সিটিতে, ভার্সিটির বাইরেও অনেকবার কফি হাউস, চাইনিজে বসেছি আমরা, রুবী আমাকে ছাড়া যেতেই চায়না, আর জামান প্রতিটা সেটিং এ আমাদের সাথে ছিল।’

লুবনাকে থামিয়ে লুবনার ভাবী বললেন, ‘রুবী লুবনাকে স্বাভাবিক রাখার জন্য প্রায় সব সময় চেষ্টা করত, লুবনাকে নিজের সাথে রাখতে এ ব্যাপারে আমার সাথে কথা হয়েছে রুবীর। জামানকে রুবী লুবনার সম্পর্কে সব জানিয়েছে- জামান সব শুনে খুব আফসোস করেছে, শুনলাম রুবীর কাছে এবং সেই থেকে আস্তে আস্তে লুবনার প্রতি বেশ কেয়ারিং হতে লাগল, চেষ্টা করতে লাগলো লুবনাকে হাসি-খুশি রাখতে। আর আমি ওদেরকে কয়েকবার বাসায় ইনভাইট করেছি। রুবীর মামাত ভাইসহ জামানকে নিয়ে আমিই বারবার আসতে বলতাম, যাতে জামান আর লুবনা স্বাভাবিক হয়ে যায়।’

লুবনা ভাবীর কথায় ফোড়ন কেটে বলল, ‘তাইতো বলি, জামান এতো ঘনঘন আমার এ্যাপার্টমেন্ট হাজির হচ্ছে কেন? তাহলে এসব তোমারই এরেঞ্জমেন্ট।’

লুবনার ভাই, লুবনার হাত ধরে বললেন, ‘তুই শুধু একবার বল জামানকে তোর কেমন লাগে?’ 

‘ভাইয়া জামানকে নিয়ে তোমাদের এতো কৌতূহল কেন? আর আমার পছন্দ অপছন্দের বিষয়টাকে এতো প্রাধান্য দিচ্ছ কেন? প্লিজ আমার আর জামানের বিষয়টা তোমরা যা ভাবছ তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল।’

লুবনার ভাইয়ের আবারও একই জিজ্ঞাসা, ‘কেনরে বোন-তোর কি জামানকে পছন্দ হয় না? ভাল লাগে না?’

‘ভাইয়া পছন্দ হয়, ভালোও লাগে, জামানকে যে কোন মেয়েরই পছন্দ হবে, কিন্তু আমি অন্য কিছু ভাবতে চাচ্ছি না ভাইয়া।’ 

লুবনার কথা শুনে লুবনার ভাবী বলে উঠল, ‘দেখো লুবনা তোমাকে আমি কখনোও আমার ননদ হিসেবে দেখিনি। নিজ সন্তানের মতই দেখেছি আর পৃথিবীর সব মা বাবা তখনই সুখে থাকে, ভালো থাকে যখন তদের সন্তান ভাল থাকে। মানুষ একা থাকতে পারে না, আর তোমার এমন কিবা বয়স হয়েছে? তোমাকে এভাবে দেখে আমাদের কারও ভালো লাগছেনা। তোমার মেজভাই, ছোটভাই আপা সবাই তোমার চিন্তায় অস্থির। সবার একই কথা- কবে তোমার এ একাকিত্ব দূর হবে? সবার এই একই প্রশ্ন।’ 

লুবনার ভাই চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন, ‘দেখ বোন আমারা তোকে যতই আদর করি না কেন, তবুও তোর একটা নিজস্ব পৃথিবী আছে। আর সেই পৃথিবীতে তোর নিজস্ব কিছু শূন্যতা আছে, যা আমার আমাদের সবটুকু দিয়েও পূর্ণ করতে পারবো না। সবার ক্ষেত্রেই একজন সঙ্গী বা পার্টনার দরকার হয়। একাকিত্ব মানুষকে মরার আগে মেরে ফেলে। আর তাছাড়া আমরা সবাইতো আমাদের জীবন আমাদের মত করে উপভোগ করছি, তুই কেন একটা তুচ্ছ ঘটনাকে মনে রেখে এতো সুন্দুর জীবনটা নষ্ট করবি- প্লিজ ফরগেট এভরিথিং এন্ড বি ফরওয়ার্ড লক্ষী বোন আমার একটু বোঝার চেষ্টা কর, তোর যদি জামানকে পছন্দ হয়, তাহলেই আমরা এগোবো, আমি কালই ম্যাানেজারকে পাঠাব ওর খোঁজ খবর নিতে, প্লিজ কিছু বল তোর ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি কিছু করব না প্রমিজ।’

ভাইয়ের এতো উচ্ছাস দেখে লুবনা কি করবে না করবে কিছু বুঝতে পারছিলো না, ‘সত্যি কথা বলতে কি, জামানকে অপছন্দ করার কিছুই নেই ভাইয়া। ঠিক আছে তোমরা যা ভালো মনে কর তাই কর তোমাদের দুঃখ কিছুটা যদি লাঘব হয় আমি তাহলে হ্যাঁ বলছি-তবে খোঁজ খবর কি নেবে, জামানের নাকি কেউ নাই- বাবা-মা যুদ্ধের সময় গত হয়েছেন, আমাদের মত জামানও মামা খালার কাছে বড় হয়েছে, আমাকে তো তাই বললো। জামালখানে ল্যান্ডমার্ক এ ওর অফিস আছে এতটুকুই জানি। সেদিন কথা প্রসঙ্গে জামান বলছিল এর থার্ড ফ্লোরে ওদের অফিস আছে, দীনা এক্সপোর্ট সেন্টার খুব সম্ভবত এটাই অফিসটার নাম বলেছিল।’ 

‘আচ্ছা ঠিক আছে, আমি রুবীর সাথে আলাপ করে দেখি ঠিকানা ম্যানেজ করা যায় কি না।’- লুবনার ভাবী লুবনার কথার মাঝেই এ কথা বললেন লুবনার ভাইকে। 

‘ঠিক আছে তাহলে আজ জামানকে ইনভাইট করো ডিনার এর ফাঁকে ফাঁকে আমি কিছু কথা বলব জামানের সাথে।’- লুবনার ভাই প্রফুল্ল সুরে লুবনার ভাবীকে বললেন। 

লুবনার ভাবী মিষ্টি এক গাল হেসে বললেন, ‘যা হুকুম জাঁহাপনা।’ 

সবাই একসাথে হেসে উঠলো, যেন অনেকক্ষণ ঝড় বৃষ্টির তান্ডব শেষে যে স্বচ্ছ আকাশটুকু দেখা যায় তারই প্রতিচ্ছায়া সকলের হাসির মাঝে বিদ্যমান। ভাবী লুবনাকে নিয়ে যেতে চাইলে লুবনা যায়নি, ফ্রেশ হয়ে একটু পরে আসবে বলে জানিয়েছে। ওদিকে লুবনার ভাবী বাড়ির খানশামাকে বলে ডিনার এর ব্যবস্থা করলেন স্পেশাল ভাবে। ভাই-ভাবী চলে গেলেন, লুবনা রুবীর সেল ফোনে  কল করল এবং টুকটাক কুশল বিনিময় করে জানতে চাইল, রাতে ওরা ডিনার করতে আসবে কি না, জামান আসবে এসব আরও টুকটাক বলার চেষ্টা করার আগেই রুবী বলে উঠলো অনেকটা হাসতে হাসতে, ‘আসতে চাইলেও আসতে পারব না। কারণ আমি এখন কুয়াকাটায়। বাসার সবাই হুট করে নিয়ে আসলো। সায়েলা ম্যাডামকে ফোন করে রিকোয়েষ্ট করেছি আমার ক্লাসটা নেয়ার জন্য।’

লুবনা বেশ নিরাশ হয়েই বলল, ‘কি আর করা, ভেবেছিলাম কিছু জরুরি কথা শেয়ার করব তুমি আসলে, আচ্ছা থাক, পরে বলব, তুমি এনজয় কর আল্লাহ হাফেজ।’ 

রুবী বেশ আশ্বস্ত কণ্ঠে বলল, ‘আমি খুব শীঘ্রই চলে আসব ডোন্টওয়ারি এসে চুটিয়ে আড্ডা দিব। আল্লাহ হাফেজ ।’ 

ফোন রেখে লুবনা সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে প্রায় অনেক সময় নিয়ে গোসল করে নিজের খুব পছন্দের নীল শাড়ি পরে, সম্পূর্ণ নীলে নীলে সেজে ভাইয়ের বাসায় যেয়ে সবাইকে চমকে দিল। সবাই  লুবনাকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক, ঠিক তেমনি লুবনাও অবাক হলো জামানকে ভাইয়ের সাথে এতো অন্ত—রঙ্গ দৃশ্যে দেখে, ভাইয়ের হাত জামানের হাতে। 

ভাবী এগিয়ে এসে বলল, ‘আজ যেন আকাশ থেকে নীলপরী নেমে এসেছে আমাদের ঘরে।’ 

সবার বিস্মিত দৃষ্টি লুবনার দিকে। লুবনা প্রথম যেদিন শাড়ি পড়ে যেভাবে লজ্জা পেয়েছিল ঠিক সেভাবেই লজ্জা রাঙা পায়ে এগিয়ে বসলো ভাইয়ের পাশে, ভাবী বসল লুবনার পাশে। সবার সাথে সবার জমে উঠলো আড্ডা। ভাই জরুরি কল এটেন্ড করতে উপরে গেলেন, ভাবী খানসামাকে টেবিল সাজাতে বলে উঠে গেলেন ডাইনিং স্পেস দেখার জন্য। লুবনা ও জামান বেশ বুঝতে পারছিল ভাই-ভাবীর এ চালাকি, কৌশলে দু’জনকে একটু একা হওয়ার সুযোগ দিলেন। জামান সুযোগের সৎ ব্যবহার করতে একটুও বিলম্ব করল না, একটু এগিয়ে এসে লুবনার হাতটা ধরে আলতো ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলল, ‘আমার জীবনে আমি কখনো এতো সুন্দর পরী দেখিনি।’ লুবনাকে কিছু বলার সুযোগই দিল না জামান। ‘প্লিজ শুধু দেখতে দাও।’ 

জামান হাত দিয়ে চেপে ধরেছে লুবনার ঠোঁট, লুবনা পরিস্থিতি সামলিয়ে জামানের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌঁড়ে চলে গেল ভাবীর কাছে। ভাবীকে কিছুটা অভিমানের সুরে বলল, ‘কি শুরু করেছ এসব তোমরা?’

 ভাবী হাসছে আর বলছে, ‘কই এখনো তো কিছুই শুরু হয়নি ম্যাডাম।’

‘বেশ তোমরা যা ইচ্ছে তাই করো, আমি আগেও তোমাদের অবাধ্য হইনি, এখনো হবো না ওকে।’ লুবনা অভিমানী, সুরেই বলে গেল কথা গুলো। খানসামা টেবিল সাজিয়ে পরিপাটি করে সকলকে বলে গেল ডিনার দেয়া হয়েছে।

সবাই খাওয়া দাওয়া শেষ করে হল রুমে গল্পে ব্যস্ত হলো আবারও । হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জামান যাবার জন্য ব্যস্ত হলো। ভাই ঘড়ি দেখে বললেন, ‘আরে সাড়ে এগারোটা বাজে। ও মাই গড্ বুঝতেই পারলাম না কখন যে এতো বেলা হলো।’ 

ভাবী অনেকটা ব্যাঙ্গ রসে বলে উঠল, ‘ভালো লাগার মুহুর্তগুলো এভাবেই চোখের পলকে চলে যায়।’ 

লুবনা ভাবীর হাত চেপে ধরল। ড্রাইভারকে ডেকে গাড়ি দিয়ে পাঠাল জামানকে লুবনার ভাই। জামান সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। ভাইয়া ভাবী লুবনাকে নিয়ে আবারও হল রুমে বসল। এ কথা সে কথা অনেক কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মুখ্য বিষয়টা ছিল জামানকে নিয়ে। ভাইয়া সব কথার শেষে বলে ফেললেন, ‘আমি জামানের অফিসে কাল ম্যানেজারকে পাঠাব খোঁজ খবর নিতে। যদি সব ঠিক থাকে তাহলে এক সপ্তাহের মধ্যেই শুভ কাজটা সেরে ফেলব।’ 

কথাটা শুনে যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো লুবনার মাথায়। কোন কথা না বলে ভাইয়ের বাসা থেকে বেরিয়ে এলো নিজের এ্যাপার্টমেন্টে। ভাইয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করতে করতে পিছু পিছু হাটতে লাগলেন লুবনার। গেট পর্যন্ত যেতেই ভাবী থামিয়ে দিল ভাইয়াকে, ‘যেওনা ওকে যেতে দাও, মনে হয় লজ্জা পেয়েছে, আজ ও একটু রেস্ট নিক কাল ইনশাআল্লাহ ভালো খবরের সাথেই লুবনার সাথে দেখা করব, আজ অনেক রাত হয়ে গেছে।’

‘তুমি ঠিক বলেছ।’ স্ত্রী কথায় সায় দিলেন লুবনার ভাই। 

‘চলো ঘুমাতে যাই’ বেশ নতুন উদ্দীপনায় ঘুমাতে গেল লুবনার ভাই-ভাবী।

এদিকে নিজের রুমে ফিরে এসে লুবনা আবারও দাঁড়াল সাওয়ারের নিচে। নিজেকে নতুন করে দেখতে লাগলো, আবারও অনেকক্ষণ ধরে গোসল করল। ওদিকে লুবনার রুমে মোবাইল বেজেই চলল একশো তিনটা মিস কল। চল্লিশটা ম্যাসেজ জামানের। ম্যাসেজ এ শুধু লেখা ছিল সরি..সরি..সরি।



পরের দিন বিকেল বেলা চলে এলেন ভাই ও ভাবী। খুব হাসি-খুশি, সাথে অনেক মিষ্টি নিয়ে এসে দেখেন লুবনা ঘুমোচ্ছে। কাজের লোকেরা বলল, ‘আফামনি, আজকে সকাল থেকেই ঘুমাচ্ছেন, আর বলছেন আফাকে যেনো কেউ না ডাকে তাই আর ডাকি নাই।’ 

ভাইয়া বেশ উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘তো আমাদের কে ফোন করিসনি কেন?’ 

ভাবী চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘কই দেখে যাও, জ্বরে লুবনার গা পুড়ে যাচ্ছে।’

লুবনার ভাই দৌড়ে বেড রুমে গেলেন। জ্বরে লুবনা চোখ খুলতে পারছিলোনা। তবুও, ভাই-ভাবীকে দেখে উঠে বসার চেষ্টা করল, কিন্তু পারছিলো না। লুবনার ভাই, কান্না কান্না গলায় বলতে লাগলেন, ‘এ সবই হয়েছে ওর একা থাকার কারণে। আজ যদি ওর নিজের বলতে কেউ ওর পাশে থাকতো তাহলে অন্তত এভাবে জ্বরে বিমর্ষ অবস্থায় পরে থাকতে হতো না। ওরা কাজের লোক ওদের কি দোষ যা, আদেশ পেয়েছে তাই করেছে।’ 

ভাবী ভাইকে থামিয়ে বলল, ‘এতো চিন্তা করো না ডাক্তার জাকিরকে ফোন করেছি, উনি এক্ষুনি আসছে, প্লিজ তুমি উত্তেজিত হয়ো না সব ঠিক হয়ে যাবে।’

ডাক্তার আসার পূর্বেই লুবনার ভাবী খানসামাকে বলেন, প্লেন ক্লিয়ার স্যুপ রান্না করতে। লুবনাকে দেখে ডাক্তার জাকির বললেন, ‘এতো টেনশন এর কিছু নেই।অতিরিক্ত পানি ব্যবহারে নরমাল ফিভার হয়েছে। আমি কিছু ওষুধ প্রেসক্রাইভ করছি দু’দিনেই একদম ঠিক হয়ে যাবে আমাদের লুবনামনি।’ 

লুবনাকে নিজের মেয়ের মতই আদর করেন ডাক্তার জাকির। সেই ছোট থেকেই একটু হাঁচি দিলেই লুবনাকে দেখতে চলে আসেন দৌঁড়েÑ ফ্যামিলি ডাক্তার বলে কথা। ডাক্তার জাকিরকে নিয়ে নিজেই ঔষুধ আনতে চলে গেল লুবনার ভাই। ইতিমধ্যে ভাবী স্যুপ খাওয়ালো লুবনাকে, লুবনা ভাবীর হাত ধরে ছলছল দৃষ্টিতে বলতে লাগল, ‘ভাইয়া কেন গেল, ড্রাইভারকে পাঠালেই হতো ঔষুধ আনতে। আমি যতো চাই আমার জন্য কারও কষ্ট যেনো না হয়, ততই কেন যেন আমি সবাইকে শুধু কষ্টই দিয়ে যাচ্ছি ভাবী।’

লুবনার মুখে হাত দিয়ে অনেকটা করুণ সুরে বলতে লাগলেন, ‘তুমি তো ভালো করেই জানো, তোমার কিছু হলে তোমার ভাইকে সামলানো মুশকিল। এবার সত্যি করে বলো তো হঠাৎ জ্বর কেন হলো? রাতেও তো তোমাকে নরমাল দেখলাম। আমরা কতো খুশি মনে এলাম আর তুমি কিনা জ্বর বাঁধিয়ে বসে আছো?’

লুবনা বুক ভরা শত কথা থাকা সত্ত্বেও কিছুই বলতে পারলো না ভাবীর জিজ্ঞাসার উত্তরে। ভাবী আবার কিছু জিজ্ঞাস করার আগেই চলে এলেন ভাইয়া। ভাই নিজেই ওষুধ এনে নিজের হাতে খাওয়ালেন লুবনাকে। লুবনা ভাইয়ের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবছে, সবার এতো ভালোবাসা স্নেহ না জানি এবার আমি কোথায় ভেসে যাব। ভাইয়ার হাসিমাখা মুখটা দেখে বলতে চাওয়া অনেক কথাই বলতে পারলো না, নিজের সাথে নিজেই যেন বিড়বিড় করতে লাগলো লুবনা। ভাই-ভাবী রাতে আর ফিরে গেলেন না নিজের ফ্লাটে, লুবনার সাথেই রয়ে গেলেন। হাসিনা বুয়া খুশিতে আত্মহারা। খুব চিন্তায় পরে গিয়েছিল লুবনার জন্যে। নিজ হাতে কোলে- পিঠে মানুষ করেছে লুবনা ও ওর মেজভাইকে। তাই অনেকটাই ভেঙ্গে পরে এদের কারও কিছু হলে। লুবনাদের এ পরিবারটা ছাড়া হাসিনা বুয়ার আর কেউ নাই, নতুন এক দারোয়ান হাসিনা বুয়াকে বেশ অবাক সুরে জানতে চায়, ‘আচ্ছা হাসিনা খালা এরা মানুষ তিনজন এত বড় বড় বাড়িতে এরা আলাদা আলাদা কেন থাকে তাও আবার পাশাপাশি বাড়ি। একলগে থাকলেই তো হয়।’ 

হাসিনা বুয়া হেসে হেসে বললো, ‘দুরও বোকা এরা পাশাপাশি আলাদা আলাদা থাকলেও এরা এক আত্মা, একজনের জন্য আর  একজন জীবন দিতে সব সময় প্রস্তুত, আলাদা থাকে বড় ভাইয়ের বিয়ের পর থেকে। এইটা এদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। সবাই সবার স্বাধীনতাকে খুব ইজ্জত করে। এত বছর এদের সাথে থাইক্যা আমি এইটাই দেখলাম। এখন চল অনেক রাত হচ্ছে- সকালে উঠতে হইবো।’ চলে গেল দারোয়ান আর হাসিনা বুয়া গেল তার রুমে ঘুমাতে।


খুব জোরে জোরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের মনোরম সুরে ঘুম ভাঙলো ভাই ও ভাবীর। লুবনা ভাই-ভাবীর রুমে টক্টকে লাল গোলাপ হাতে জোরে শুভসকাল বলে চমকে দিল দু’জনকেই। লুবনার সুস্থতা দেখে রীতিমত  অবাক হল ভাই ভাবী। দু’জনই সৃষ্টিকর্তার কাছে দু’হাত তুলে কৃতজ্ঞতায় অশ্রু ছলছল নয়নে শুকরিয়া জ্ঞাপন করলো। খুশিতে আত্মহারা ভাই ভাবী জড়িয়ে আদর করলেন লুবনাকে। 

‘আচ্ছা উঠো ফ্রেশ হও খুব ক্ষিদে পেয়েছে খানসামা নাস্তা টেবিলে দিয়েছে’- লুবনা দু’হাত দিয়ে ভাই ভাবীর চোখ মুছে তাদের স্বাভাবিক করার জন্য কথাগুলো বলল। 

‘একাকিত্ব কত কষ্টের কাল আমি তা বুঝলাম নাস্তার টেবিলে’ খুব দীর্ঘ শ্বাসে লুবনার ভাই বলল কথাগুলো।

লুবনার ভাবীও সায় দিলেন লুবনার ভাইয়ের কথায়, ‘তুমি এতোটা দিন কিভাবে কি যন্ত্রণায় সময় পার করেছো তা আমি গতরাত জেগে জেগে শুধু ভেবেছি আর তাই এক মুহুর্তও আমি তোমায় এ দুর্বিসহ কষ্ট সহ্য করতে দেব না। প্লিজ লুবনা তুমি, আর মানা করনা দেখ সব কিছু থাকলেও পার্টনার না থাকলে সব কিছুই অর্থহীন জীবনে। আমি গতকাল সকালে ম্যানেজারকে পাঠিয়েছিলাম জামানের অফিসে, ম্যানেজার যা রিপোর্ট দিল, তাতে জামান খুব ভাল ছেলে, খুবই বিনয়ী, রোটাস এ্যাড ফার্মের মালিক জামান। অথচ আমাদের বুঝতেও দেয়নি যে তার এতো ভালো ব্যবসা আছে, নিশ্চয়ই তোমাকেও বলেনি?’ 

লুবনার হাত ধরে বলে চললো লুবনার ভাই। ‘এ ভালো খবরটা দিতেই গতকাল বিকালে এখানে এলাম তোমাকে জানাব বলে। তোমার অসুস্থতা দেখে আর কিছুই বলা হল না। ম্যানেজার বলল, সে খুবই সাবধানে খোঁজ খবর নিয়েছে। কেউ কিছু বুঝতে পারেনি। আরও বলল, অফিসে জামান নামে আরও দুজন আছে তাদের সর্ম্পকে বেশ বাজে কথা শুনে আসলো অফিসের দারোয়ানের কাছে। অফিস শুরুর আগেই ম্যানেজার সব খোঁজ খবর নিয়ে আমাকে জানিয়েছে এসব।'

ভাবী এবং লুবনা মন্ত্রমুগ্ধের মতো পিন পতন নীরবতায় শুনছিলো ভাইয়ের কথাগুলো।

‘তাহলে তো শুভ কাজে আর দেরী করার দরকার নাই। জামানকে বলি ওর পক্ষ থেকে গার্জিয়ান এসে দু’ একদিনের মধ্যেই শুভ কাজটা যেনো সেরে ফেলে। আল্লাহ আমাদের মনের আশা পুর্ণ করেছেন।’ 

লুবনা হেসে বলল, ‘ভাবী তুমি এতবার জামানের সাথে কথা বললে অথচ জানো না, জামানের বাবা-মা কেউ নেই। ও আমাদের মত মামা খালার কাছে বড় হয়েছে। কিছুদিন আগে সেই মামা মারা গেছে। আর খালা ৭১ এর পরে ইতালী চলে গেছে। জামানদের সাথে এর পরে আর কোন যোগাযোগ রাখেনি, বেঁচে আছে না মরে গেছে তাও নাকি জানেনা।’ 

লুবনার ভাই খুব আফসোস করলেন জামানের জন্য, ‘ছেলেটা তাহলে আমাদের মতই এতিম। ছেলেটা তো একেবারে পারফেক্ট। ও বুঝবে সর্ম্পকের গুরুত্ব।’ 

লুবনার ভাইকে ভাবী কথার মধ্যে থামিয়ে বলল, ‘তাহলে পরশু দিন শুক্রবার শুভ কাজটা  সেরে ফেললে কেমন হয়?’ 

লুবনারে ভাই ভাবীকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আমার মুখের কথা কেড়ে নিলে আমিও তাই বলতে চাচ্ছিলাম। শুক্রবার বাদ এশা শুভ কাজটা হয়ে যাক। জামানকে ফোন করে জেনে নেই ওর কোন আপত্তি আছে কিনা?’

লুবনা কিছু বলার আগেই টেবিল ছেড়ে ফোনে ব্যস্ত হয়ে গেলেন লুবনার ভাই। যাই, গোছগাছ শুরু করে ফেলি। বলেই ভাবীও দৌঁড়ছূট শুরু করলো, যাবার আগে কাজের লোকদের সব ইন্সট্রাকশন দিয়ে। লুবানার মুখে মিষ্টি গুজে ভাই ভাবী বেরিয়ে পড়লেন হাসিমুখে লুবনার এ্যাপার্টম্যান্ট থেকে। যাবার আগে লুবনার সামনেই লুবনার অন্য সব ভাই ভাবী ও বোনকে জানিয়ে দিলেন এ শুভ বারতা। লুবনার কপালে চুমু দিয়ে তারপর বেড়িয়ে পড়ল ভাই ভাবী দু’জন। জামান ফোনে যেই হ্যাঁ বলল ওমনি কারেন্ট গতিতে ভাই-ভাবী এতো কিছু করে ফেলল মুহূর্তেই। আসলে মনের শক্তিটাই বড় শক্তি মুহুর্তেই হাওয়ায় বিলীন হয়ে গেল ভাই ভাবীর বিমর্ষতা। হাওয়ায় বেজে উঠলো সানাইয়ের সুর। যেমন কথা তেমন কাজ। পূর্ব নির্ধারিত সময়ে সব কিছু হলো অত্যন্ত সুন্দর ভাবে। শেষ হলো সব জল্পনা কল্পনার। পৃথিবীর সব সুন্দর ফুলের সমারোহে সুসজ্জ্বিত হলো লুবনা ও জামানের মাত্র ৪৮ ঘণ্টার প্রস্তুতিতে এত পরিপাটি বিয়ে যা অনেকের কাছেই বিস্ময়। যেমন জামানের ড্রেস, তেমনি লুবনার খাওয়া-দাওয়া কোথাও কোন ঘাটতি ছিল না। লুবনার ভাই ও বোন আগেই বলেছিল বিয়েতে এটেন্ড করতে পারবে না। পূর্বের মন মানসিকতা এখনো সহজ করে নিতে পারছিলো না লুবনার অন্য দুই ভাবী ও ভাই। আর বোনতো অসুস্থ নিথর দেহ নিয়ে পড়ে আছে কানাডায় তাই তারও আসা সম্ভব না।

নিজের ভাই বোনের অনুপস্থিতি ছাড়া আর কোন ঘাটতি ছিল না লুবনার বিয়েতে। অনেক আশা অনেক স্বপ্ন দিয়ে কানায় কানায় পরিপূর্ণ করার চেষ্টা করেছে লুবনার ভাই ভাবী। লুবনার বিয়ের আয়োজনকে বেশ প্রশংসা করছিল সবাই। নতুন আশায় শুরু হলো লুবনার জীবনের এ নতুন অধ্যায়।


সকাল বেলা লুবনার ঘুম ভাঙলো জামানের তড়িঘড়ি তৈরীর চোটে। হাত থেকে পড়ে যাওয়া মোবাইল ফোনের শব্দে লুবনা চোখ খুলতেই জামানকে কমপ্লিট স্যুটেড বুটেড হয়ে তৈরী দেখল। লুবনা বিছানার পাশেই থাকা গাউন ব্লাংকেটের ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে নিয়ে চট করে ওঠে পড়ল, ‘কি ব্যাপার এত সকালে, কোথায় যাচ্ছ তুমি?’ খুব বিস্ময়ে জানতে চাইল লুবনা।

জামান লুবনার হাত ধরে বললো, ‘বিশ্বাস করো আমার একটুও যেতে ইচ্ছে করছে না, রাতে কি একটুও ঘুমিয়েছি বলো? তুমিও তো ঘুমাওনি, ঘুমাতেও দাওনি আমায়।’ 

লুবনা জামানের বুকে মাথা গুজে মিষ্টি হেসে বললো, ‘আচ্ছা আমি কখন ঘুমালাম বলোতো?’

জামান লুবনাকে শক্ত বাহুডোরে আরও একটু শক্ত করে চেপে ধরে বললো, ‘এইতো দু’ঘণ্টা আগে।’ 

‘তা হলে তুমি ঘুমাওনি?’ লুবনার জিজ্ঞাসা। 

‘না একটুও ঘুমাইনি, উঠলাম, গোসল করলাম রেডি হলাম, অফিসে কল দিলাম, আমি আসছি জানালাম কারন আজ নয়টায় একটা মিটিং আছে।’

লুবনা বেশ অবাক হয়ে বললো, ‘তুমি অফিস থেকে ছুটি নাওনি? অফিসে জানওনি বিয়ের কথা।’ 

লুবনা নিজেকে ছাড়িয়ে নিল জামানের বাহুডোর থেকে ছলছল জলে ভরা চোখে চেয়ে থাকলো জামানের দিকে।

জামান মুহূর্তেই গলার স্বর গম্ভির করে বললো, ‘দেখ লুবনা, প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো, এতো ঘটা করে অফিসে বিয়ের কথা বলার কি আছে? আর তাছাড়া এটা তো তোমার প্রথম বিয়ে নয়, এই চট্টগ্রামে তোমরা বেশ নাম করা পরিবার, সবাই চেনে জানে তোমাদের, আমার অফিস কলিগরা বলবে সেকেন্ডহ্যান্ড বিয়ে করেছি, তাই বিয়ে করেছি কথাটা বলতে লজ্জা লাগছিল, অফিসে তাই জানাইনি যে আমি বিয়ে করছি। বুঝতেই তো পারছ মানুষের মুখতো আমি ধরে রাখতে পারবো না। আবার হয়ত ভাববে আমি তোমাদের সম্পত্তির লোভে তোমায় বিয়ে করেছি। বুঝতেই পারছ লুবনা অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে।’

লুবনা জামানের কথায় ঠাস্ করে বসে পড়লো খাটে। আকাশ মাথায় ভেঙে পড়ার মতো দুঃসহ যন্ত্রনায় নিঃশ্বাস যেনো বন্ধ হতে লাগলো লুবনার। চোখ হতে গরম নোনা জলগুলো গড়গড় করে ঝরে পড়তে লাগলো। মুহূর্তেই অচেনা লাগলো জামানকে। বিধ্বস্ত কণ্ঠে জানতে চাইল জামানের কাছে, ‘তোমার সাথেই কি আমি নির্ঘুম একটা রাত কাটালাম, তুমি তো আমায় আলিঙ্গনে বিভোর রাখলে পুরো রাত। আমার সেকেন্ড ম্যারেজ এটা কি তোমার অজানা ছিল? আর আমি কি তোমার কাছে বিয়ে বসতে গিয়েছিলাম? আমার দ্বিতীয় বিয়ে তোমার সাথে এটা কি গর্হিত কোন বিষয়? লজ্জা হচ্ছে এ কথা সাত-আট দিন আগেও তো বললে না? কত সম্মান দেখালে, ভালোবাসা দেখালে, দরদ দেখালে? আর এখন বলছো, আমাকে বিয়ে করেছো এটা বলতে লজ্জা লাগছে? তোমরা পুরুষরা এতো বহুরূপী কেন? কিছুটা মুহূর্তের তন্দ্রাতেই তুমি আমায় আবার মুখোমুখি করলে এ নির্মম বাস্তবতায়, কেন জামান, কেন?’ 

জামান খুবই  চালাক মুহূর্তেই ঘূর্নির মত ঘুরিয়ে নিল নিজেকে। লুবনাকে শান্ত হতে বলে হাত ধরে লুবনাকে খাটে বসাল, নিজে লুবনার পা ঘেঁষে নিচে বসে বলতে শুরু করলো ‘দেখ লুবনা প্লিজ আমাকে ভুল বুঝোনা লক্ষীটি, কথাগুলো তো আর আমার না- আমিতো কিছু বলবো না, কিন্তু বাইরের মানুষ। আমাকে একটু বোঝার চেষ্টা কর প্লিজ।’  

লুবনা উঠে দাড়াল, ‘তুমি কি আমাকে করুণা করছো? আমি কি দুধ খাওয়া বাবু? আমি সব বুঝতে পারছি। বিধাতা নারীকে বিচিত্র রূপে গড়েছে, নারীকে বোঝা বড় দায়, আরও কতো কি মনগড়া কথা নারীর বিরুদ্ধে পড়ে পড়ে শুনে শুনে বড় হয়েছি, কিন্তু আমার জীবনে দেখা দুটো পুরুষ দুটোই যে কতো বড় বহুরূপী তা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও হয়তোবা জানে না। তুমি কি’না ফিলিংস দেখালে আমার প্রতি আর আজ ঠুনকো একটা লজিক দিয়ে আড়াল করতে চাচ্ছো তোমার বিকৃত চেহারা? প্লিজ জামান তুমি অফিসে যাও, আমি ফ্রেশ রুমে যাবো। সারারাত তোমার যে মূল্যবান আদরে আদরে আমার মতো সেকেন্ডহ্যান্ড মহিলার পুরো শরীর জুড়ে একে দিয়েছো পৌরুষত্বের যে গৌরবী ছাপ, তা ওয়াশ করবো-বাই।’ 

লুবনা খানসামাকে টেবিলে নাস্তা দিতে বলে - ফ্রেশ রুমে চলে গেল। জামান শত চেষ্টা করে ধরতে পারলো না দ্রুত বেগে ছুটে যাওয়া লুবনাকে। জামানের আর একটি কথাও শুনলো না লুবনা। জামান দু’ একবার দরোজায় টোকা দিল ফ্রেশ রুমের, কিন্তু কোন সাড়া শব্দ পেলো না। বাসায় কাজের লোকরা আছে যদি কেউ কিছু শুনে জীবনে শ্রেষ্ঠ ভুল করেছে হুট করে সেকেন্ড হ্যান্ড কথাটা বলে। নিজেকে নিজেই বিড়বিড় করে বলতে লাগলো জামান। পরিবেশটা কাজের লোকরা যেন বুঝতে না পারে তাই হাল্কা নাস্তা করে বেরিয়ে গেল জামান। হাসিনা বুয়া খুব অবাক হলো জামানকে একা খেতে এবং এভাবে বেড়িয়ে যেতে দেখে। 

খানসামা বলল, ‘বড় ম্যাডাম রাতে বলে গেল উনারা দুপুরে আসবে আরও কয়েকজন গেষ্ট আসবে, খুব সুন্দর করে পার্টির রান্না করতে বলেছিল, কিন্তু জামাই বাবাজি যে এতো সকালে যাবে, উফ্ কিছুই তো বুঝতে পারতেছিনা হাসিনা আপা।’ 

‘তুমি তোমার কাজ করো, বড় ম্যাডাম  যা বলেছে তুমি তাই কর। জামাই বাবা নিশ্চয়ই কোন জরুরি কাজে বাইরে গেছে চলে আসবে। তুমি তোমার পার্টির রান্না শুরু করো’ হাসিনা বুয়া খানসামাকে বেশ শান্ত স্বরে বললো। ‘কিন্তু কেন জানি আজ তার বুকটা ধড়ফড় করছে’- বিড়বিড় করে বলল হাসিনা বুয়া।

লুবনার ফোনে কল এসেই যাচ্ছে একের পর এক। একবার জামানের একবার রুবীর হাজবেন্ডের। লুবনা ফ্রেশ হয়ে বের হইতে রিং শুনলো, মোবাইলে দেখলো অনেক গুলো কল। ঠিক এই মুহূর্তে কোন কল ধরতে বা করতে ইচ্ছে হচ্ছিল না লুবনার। লুবনা ইজি চেয়ারে বসলো ঠিক কি করবে বুঝতে পারছিলো না, ভাবীর কাছে যাবে, নাকি কি করবে। চোখের পানি বাঁধভাঙ্গা ঢেউয়ের মত গড়িয়েই যাচ্ছে অনবরত। আবারও বেজে উঠলো ফোন, লুবনা চোখের পানি মুছে নিজেকে একটু সামলে রিসিভ করলো কলটি। আকাশ থেকে পড়ার মত অবাক হলো লুবনা রুবীর হাজব্যান্ড মানে রুবেল ভাইয়ের কল দেখে। 

‘রুবেল ভাই আপনি? এ সময়? কেমন আছেন? রুবী ভালো আছে তো?’

‘লুবনা এত কথার উত্তর এক সাথে  দিতে পারব না শুধু এটুকু বলো তুমি কি বাসায় আছো?’ 

‘হ্যা রুবেল ভাই আমি বাসায় আছি, কেন কি হয়েছে? প্লিজ বলুন টেন্স হচ্ছে।’

‘তোমার ল্যান্ডফোনে অনেক ট্রাই করলাম কিন্তু কেউ ধরছে না। তাই ভাবলাম হয়তো কেউ বাসায় নেই। আচ্ছা তুমি বাসায় থাক আমরা দশ-পনের মিনিটের মধ্যে আসছি। দেরি হবে না।’

‘ওকে ওকে আসুন, আমি বাসায় আছি আর  ল্যান্ডফোন গত রাতে ভাবী ডিসকানেক্ট করে গেছেন, যেন আমাদের ডিসটার্ব না হয়, ভাবী তো মোবাইলও চাচ্ছিলেন। ভাগ্যিস দেইনি, আচ্ছা সাক্ষাতে কথা হবে আসুন।‘

রুবেল আসছি বলেই লাইন কেটে দিল।

লুবনা ক্লান্ত মনে ফুলে ফুলে সাজানো ঘরটি বার বার দেখছে আর ফুঁপিয়ে কাঁদছে। একটা রাতেই অচেনা হয়ে গেল মানুষটি। সব ভুল মানুষ গুলো সৃষ্টিকর্তা আমার জন্যই সৃষ্টি করলো। জামান যা বলেছে সত্যি কথাই তো বলেছে। পৃথিবীর কোন ঐশ্বর্য্য দিয়েও এ রঢ় সত্যকে লুকাতে পারব না। হে বিধাতা কেন আমার কপালে সেকেন্ডহ্যান্ড এ কলংকটুকু লেপে দিলে? মানুষও পণ্যের মত সেকেন্ডহ্যান্ড হয়ে যায় এটা আমি তো বুঝতে পারিনি মনেও আসেনি এ ধরনের কথা। ফুল সজ্জার সাজানো লহর গুলো টেনে টেনে ছিড়ে ফেলছে আর নিজেকে বারবার সেকেন্ডহ্যান্ড বলে চোখের জলে বুক ভাসাচ্ছে। নিজের কথা গুলো নিজেই বারবার বলেই চলেছে। জামানের এ অচেনারূপে খুবই মর্মাহত হলো লুবনা। সেকেন্ড হ্যান্ড কথাটি তীরের মতো বিঁধেছে তার বুকে।

আবারও কঠিন বাস্তবে ফিরে এলো লুবনা হাসিনা বুয়ার ডাকে। আপামনি আপামনি বলে হাসিনা বুয়া দরজা নক্ করলো দু’তিন বার। বলল, ‘আপামনি রুবী আপা আসছে, হল রুমে অপেক্ষা করতেছে।’ রুমের ভিতর থেকেই লুবনা বললো, ‘খালা আপানি ওখানে চা নাস্তা দেন আমি আসছি’

লুবনা দরজা না খুলেই কথাগুলো বলে ফ্রেশ রুমে যেয়ে মুখ চোখে পানি দিয়ে যতটা সম্ভব নিজেকে গুছিয়ে নিচে নামলো। লুবনা হল রুমে ঢুকেই জড়িয়ে ধরলো রুবীকে। পিংককালারের থ্রী পিছ পড়া রুবিকে কিযে মায়াবী লাগছে। লুবনা বলেই বসলো রুবী ওয়াউ! লুবনা খুব অবাক স্বরে বলল, ‘কুয়াকাটা থেকে কবে আসা হলো? সব ঠিক তো? রুবেল ভাই কেমন আছেন?’ 

লুবনা একগাল হেসে জিজ্ঞেস করল রুবেল কে। রুবী শুধু চেয়েই থাকছে লুবনার দিকে। রুবেল বলল, ‘আমরা আজ ভোর সাতটায় পৌঁছেছি। জাস্ট ফ্রেশ হয়ে তোমাকে খুব জরুরি কিছু বলব বলেই ছুটে আসা। তোমার মোবাইল অফ,  বাসার টি.এন্ড.টি তে পাচ্ছিলাম না ভাবীকেও ট্রাই করলাম, ভাইকেও কিন্তু কারো সাথে কানেক্ট হতে পারিনি।’

লুবনা খুব অস্থির হয়ে জানতে চাইল, ‘এমন কি ইমারজেন্সি রুবেল ভাই? আমি তো নিজেও রুবীকে ও আপনাকে অনেক ফোন করেছিলাম কিন্তু রুবীকেও পাইনি, আপনাকেও না। রুবীর সাথে এর আগে যখন কথা হয়েছিলো তখন বলেছিল ওর চার্জার হাত থেকে পড়ে ভেঙ্গে গেছে আর কুয়াকাটায় নেটওয়ার্ক সমস্যা। আমি, আমার ও জামানের বিয়ের দাওয়াত এবং আর কিছু পারসোনাল কথা রুবীকে ম্যাসেজ করেছিলাম কথা বলতে না পেরে।‘

‘ওই মেসেজের কারনেই তো রুবেল অস্থির হয়ে গেছে আর তাই দুদিন পরে আসার কথা ছিল। কিন্তু দু’দিন আগেই চলে আসতে হলো কিন্তু এসে আর কি লাভ হলো। আমরা তো কিছুই করতে পারলাম না। আর তুমিতো লিখেছিলে মেসেজে এক সপ্তাহ পর বিয়ে কিন্তু......’ রুবি হতাশার সুরে বলল।

‘ইস ভাইয়া ভাবী জামান সর্ম্পকে যখন সব ক্লিয়ারেন্স পেল তখন হুট করেই সিডিউল চেইনজ হলো’- লুবনা কথা শেষ করতে না করতেই হাসিনা বুয়া টলিতে বাহারি নাস্তা নিয়ে এলো। রুবেল পরিস্থিতি একটু সামাল দিতে হালকা নাস্তা পর্ব সারল, লুবনা ও রুবী শুধু চা নিল। চা সেরে রুবী লুবনার হাত ধরে বলল, আমি তোমার ম্যাসেজ পরে রীতিমত হকচকিয়ে গেলাম, জামানের সাথে তোমার বিয়ে। লুবনা রুবীকে থামিয়ে বলল, ‘প্লিজ আমি আর টেনশন রাখতে পারছিনা প্লিজ কেন তখন থেকে বারবার বলছ- আমার আর জামানের বিয়ের খবরেই কেন এতো অস্থির তোমরা?’

‘লুবনা তোমাকে আমি বোনের মতই স্নেহ করি তাই কথা বলার আগে শুধু একটা কথা বলব, প্লিজ তুমি ধৈর্য্য ধর তোমাকে অনেক শক্ত হতে হবে।’-রুবেলের মিনতি।

‘প্লিজ রুবেল ভাই বলেন কি হয়েছে? আমি ঠিক আছি, আমি ভেঙ্গে পড়বো না বলেন।’

রুবী লুবনাকে শান্ত করে বসালো সোফায়। রুবী ও রুবেল লুবনার দু’পাশে বসল।

‘আর কোন কথা না বলে সরাসরি জামান প্রসঙ্গে বলুন প্লিজ’- লুবনা দু’হাতে দুজনের হাত ধরে করুণ মিনতি করলো।

‘জামান আমাদের সবার সাথে চালাকি করেছে। আমাদের স্যারের কাছে ওর নিজের সর্ম্পকে সব কিছু অস্পস্ট রেখেছে।’- কথা গুলো নিঃশ্বাস না ফেলে প্রায় একদমে বললো রুবেল। 

লুবনা আবারও অস্থির সুরে, ‘আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা রুবেল ভাই প্লিজ খুলে বলুন।’

এমন সময় ভাবী ঘরে ঢুকলো, ‘আরে আরে কে কাকে কি খুলে বলবে? আরে রুবী রুবেল তোমারা? এতো দেখি মেঘ না চাইতে বৃষ্টি...কবে আসলে তোমার কুয়াকাটা থেকে?  দু’দিন পরে আসার কথা?’

ভাবী কথায় ভাইয়া বলে উঠলো, ‘আরে আরে করছো কি? তুমি তো দেখি উকিলের মতো প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেই যাচ্ছো?

‘স্যরি..স্যরি।’ 

না না ঠিক আছে ভাবী। হাসিনা খালা বলল, আপনারা দুপুররে আসবেন?-রুবী স্বলাজ হেসে জানতে চাইলো।

‘ইস দুপুরেই আসতাম তোমার ভাই আর আমি হঠাৎ করে প্ল্যান করলাম, দুপুর বেলা সবাই এক সাথে খাওয়া দাওয়া করে রাতে একটা ছোট মিটিং করবো। লুবনা আর জামানকে আগামী সপ্তাহে এশিয়া ট্যুরে পাঠাব। এত সাদামাটা বিয়ে হলো কিছুই দেয়া হয়নি, ভাবলাম এই ট্যুরটা আমাদের পক্ষ থেকে ওদের জন্য বিয়ের গিফ্ট। তাই হুট করে চলে এলাম। কিন্তু তোমরা কুয়াকাটা থেকে কখন..? ভাবীর পাল্টা প্রশ্ন।

রুবেল ভাবীকে থামিয়ে বলল, ‘ভাবী ভাই আপনারা প্লিজ এখন অন্য সব কথা বাদ দিয়ে একটু শান্ত হয়ে বসুন খুব জরুরী কথা, ভয়ংকর একটা সমস্যা হয়ে গেছে- আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না প্লিজ আমাকে কথা গুলো বলতে দিন।’ 

লুবনার ভাই ভাবী প্রায় হকচকিয়ে গেল, ‘রুবেল আবার কি সমস্যা হলো লুবনাকে এতো বিধ্বস্ত লাগছে কেন?’

রুবী ভাইকে হাত ধরে বসাল, ভাবীও বসল ভাইয়ের পাশে। থমথমে একটা পরিবেশ সৃষ্টি হলো মুহুর্তেই ঘর জুড়ে। লুবনা একেবারেই চুপ..

রুবেল বলল, ‘ভালো হলো আপনারা চলে এসেছেন, খুব প্রয়োজন ছিল আপনাদেরকে। জামান আমার বন্ধু ঠিক আছে, কিন্তু এতোটা ঘনিষ্ঠতা ছিলনা কোনদিনই।’

অফিসিয়াল কোন কাজে যখনি দরকার হতো রেস্টুরেন্ট বসতাম- কয়েক বার রুবীর সাথে দেখা করার সময় জামানসহ গিয়েছি, ফোনে কথা হতো এই আরকি। কিন্তু ওর ব্যক্তিগত কিছুই আমি জানি না বা জানতেও চাইনি। এরই মধ্যে জামান রুবীর ও লুবনার কাছে বেশ গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিল। কয়েকবার আপনাদের বাসায়ও আসলো। রুবী বলেছিল কোন একদিন রুবী ও লুবনার সাথে মিনি সুপার মার্কেটে ওদের দেখা হয়েছিল জামানের সাথে। তখন জামান লুবনার কাছ থেকে ফোন নাম্বার নিয়েছিল, রুবীর টাও নিয়েছিল। আমি মাঝে মাঝে কোম্পানীর কাজে ঢাকা যেতাম এই ফাঁকে জামান  রুবী ও লুবনা বেশ কয়েকবার কয়েক জায়গায় একত্রে বসেছে আড্ডা দিয়েছে। আমিও খুশি হতাম যেহেতু আমার ব্যস্ততার কারণে আমি কম বসতে পারতাম একত্রে, লুবনাকে প্রায় নাকি জামান ফোন করত। ভাবী মনে মনে চাইত লুবনার আর জামানের মধ্যে ভাল একটা বন্ধুত্ব হোক, তাহলে লুবনা এতটা বিমর্ষ থাকবে না।  আমাদের চাওয়া ছিল স্রেফ বন্ধুত্ব পর্যন্ত।’

ভাই দাঁড়িয়ে উত্তেজিত কন্ঠে রুবেলকে ধরে বললেন, ‘তুমি কি বলতে চাচ্ছ রুবেল, আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না। আর কন্ট্রোল করতে পারছি না। আমি.....’

রুবী আবারও বসালো ভাইকে, ‘প্লিজ ভাইয়া শান্ত হোন প্লিজ।’

রুবেল বলল, ‘আপনি শান্ত হোন ভাইয়া, আমি সব বলছি প্লিজ বি পেশেন্স এন্ড থিংক এবাউট লুবনা’ 

রুবেল ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আবারও শুরু করল কথা কাপাঁ কাপাঁ কন্ঠে। ‘আমি জামান ও লুবনার বিয়ের খবর শুনে বেশ অবাক হলাম। রুবী যখন দেখাল ওর মোবাইল মেসেজে লুবনা আমাদের তাড়াতাড়ি আসতেও বলেছে এক সপ্তাহ পরে বিয়ে। আমি দু’তিন বার ম্যাসেজটা পড়লাম- তখনি আমার কেমন যেন একটা খটকা লাগলো। এত তাড়াহুড়া কেন, যাই হোক কুয়াকাটায় আমাদের সারপ্রাইজিং ট্যুর ছিলো তাই খুব একটা গোছানো  ছিলো না কিছুই। রুবীর হাত থেকে পড়ে চার্জারটা নষ্ট হয়ে গেল আর নেটওয়ার্ক এত সমস্যা ছিল হোটেলের ছাদে গেলে এক-আধটু পাওয়া যেত। রুবী জানিয়েছিল লুবনাকে বলেও ছিল কোন ইম্পরটেন্ট কথা থাকলে ম্যাসেজ করতে। যখনি নেটওয়াকর্রে মধ্যে যাব খবর পাব এ উদ্দেশ্যে। ওদের বিয়ের খবর শুনে আগাম কনগ্রেটস জানাতে কল করেছিলাম। কিন্তু দু’জনের মোবাইল অফ কোন ভাবেই যোগাযোগ করতে পারলাম না। দু’ঘণ্টা ছাদে দাঁড়িয়ে ট্রাই করেছি হঠাৎ রুবী বলল, জামানের অফিসে ফোন দিতে। আমি দিতে চাইনি কারণ এগারোটা বাজে এ সময় মানে লাঞ্চের আগে অফিসে কাজের চাপ থাকে প্রচুর। তবুও করলাম রুবীর পীড়াপীড়িতে। জামানের অফিসের নাম্বার থেকে জামান আমাকে অনেক বার ফোন দিয়েছে তাই নাম্বারটি আমার মোবাইলে সেভ করাই ছিল। রিসিপশনের ভদ্র মহিলার সাথে তিন চার বার কথা হয়েছে মোটামুটি ভালই চিনেন আমাকে। জামানের বন্ধু বললেই তাড়াতাড়ি লাইন পাস করে দেন। ফোন দিতে ভদ্রমহিলা ধরলেন আমি জামানকে চাইতেই উনি বললেন আপনার বন্ধু তো অফিসে নেই। কোন ম্যাসেজ থাকলে বলুন দিয়ে দিব। আমি খুব আশাহত হলাম । না থাক কিছু বলতে হবে না। একটু কনগ্রেটস করতে চেয়েছিলাম তা বোধ হয় প্রকৃতি চাচ্ছে না, তাই সব চেষ্টাতেই ব্যর্থ হলাম বলে ফোন রাখি বলতেই ওপার থেকে ভদ্র মহিলা জিঙ্গেস করলেন কিসের জন্য কনগ্রেটস? যদি আপনার আপত্তি না থাকে উনি আবার এমন কি ভাল করলেন যে কনগ্রেস দিতে হবে বেশ ক্ষোভ নিয়েই কথাগুলো বললেন ভদ্র মহিলা। কেন জামান কি তিন চার দিন আগেই অফিস থেকে ছুটি নেয় নি? আর ওর বিয়েতে অফিস কলিগদের ইনভাইট করেননি? রিসিপশনিস্ট বলল আমার মাথা ধরে যাচ্ছে, কি আবোল তাবোল বলছেন রুবেল সাহেব? জামান সাহেব বিয়ে ছুটি এসব কি? উনি আবার বিয়ে করছেন নাকি? উনার প্রথম বৌ জানে? আমি অবাক হয়ে বললাম হ্যালো ম্যাডাম আপনি কি বলছেন, রসিকতা করছেন নাতো? জামানের প্রথম বৌ। রিসিপশস্টি বললেন দেখুন অফিসে অনেক কাজ এসব অবান্তর কথার সময় আমার নেই। কেন আপনি জানেন না? আপনি না ওনার বন্ধু? আমি বললাম ম্যাডাম প্লিজ আপনি রাগ না করে আমাকে একটু বলুন জামান সম্পর্কে আমি ওর ব্যক্তিগত কিছুই জানি না। আমার ওর সাথে এত ঘনিষ্ঠ কিছু না- আমার মিসেসের বান্ধবীর সাথে আগামী সপ্তাহে ওর বিয়ে তাই কনগ্রেস করার জন্য ফোন করেছিলাম- আর আপনি বলছেন...রিসেপশনিস্ট অবাক হয়ে বলল : কি বলেন সর্বনাশের কথা। যে করেই হোক এ বিয়ে থামান। জামান পূর্ব বিবাহিত তার দু’টি মেয়ে আছে। এবং সত্যি কথা বলতে উনি খুব ছেচকা টাইপের লোক। অফিসের অনেকের কাছ থেকে উনি প্রায়ই টাকা লোন নেন এখনও অনেকে উনার কাছে টাকা পায় তাদের মধ্যে আমিও একজন। অফিসে জামান নামে আরও দু’জন ভদ্রলোক আছেন। এই জামানের জন্য অনেকবার উনারাও বিড়ম্বনায় পড়েন। অনেক পাওনাদার ফোনে জামান সাহেব ভেবে আমাদের চেয়ারম্যান স্যার, একাউন্টের জামান স্যারকে প্রায় হুমকী ধমকী দেন। কত উল্টা পাল্টা চিঠি আসে পিয়ন প্রায় ভুল করে ওই দুই স্যারকে চিঠি গুলো দিয়ে দেয়। চেয়ারম্যান স্যারের আত্মীয় বলে- স্যারও কিছু বলেন না। আমরা আর কি বলব। তবে লোকটা যে এতো জঘন্য তা জানতাম না।

রুবেল : ম্যাডাম আমি ঠিক কি বলব জানিনা তবে এতোটুকু বলব যার সাথে সে এতবড় প্রতারণা করতে যাচ্ছে সেই মেয়েটা খুবই ইনোসেন্ট। আমি ওকে কোনদিনও ছাড়ব না আমি অনেক দূরে কুয়াকাটায় ম্যাডাম আমাকে এক্ষুনি রানিং গাড়িতে উঠতে হবে- প্লিজ আপনি ভুল বুঝবেন না- আমি রাখি, আমার পায়োর নীচে মনে হচ্ছে মাটি নাই।

রিসিপশন : নিজেকে সামলান আর এটাই ভাল হবে মোবাইল ট্রাই করতে থাকুন মেয়ে পক্ষদের সাথে এবং যে করেই হোক বিয়েটা থামান। 

ঠিক ওই মুহূর্তে রুবীকে নিয়ে আমরা রওয়না হয়েছি- পথে রুবীকে সব বললাম, রুবী তো কাঁদতে কাঁদতে পুরো রাস্তা ট্রাই করল কিন্তু আর বিয়েটা যে তিন চার দিন আগেই হয়ে গেল তা তো আমরা জানি না। লুবনার মেসেজে ছিল এক সপ্তাহ পর বিয়ে, আমি ভাবলাম বিয়েটা আমি ঠেকাতে পারব যেহেতু দু’দিন আগেই জামানের আসল চেহারা জানার পর একটা মুহূর্ত দেরি করিনি কিন্তু...

‘অফিসের ম্যানেজার যখন এতো ভাল রিপোর্ট দিল জামান সম্পর্কে। তাই আমিই এ সর্বনাশটা করে ফেললাম। হায়! ম্যনেজার এ কি রিপোর্ট আনলো?-হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন ভাই।

‘অনেকের মত ম্যানেজারও একই ভুল করেছে। জামানের অফিসে তিনজন জামান নামের লোক আছে। অফিসের চেয়ারম্যানের নামও জামান।’   রুবেল জানালো ভাইকে।

রুবেলকে ধরে কাঁদছে ভাই আর বলছে, ‘এ আমি কি করলাম।’ 

ভাবী, রুবী, রুবেল, ভাইকে শান্ত হতে বলেই দেখল, লুবনা বরফ হয়ে জমে যাবার মত হয়ে গেছে।  লুবনাকে ভাই ভাবী সবাই সামাল দেয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করল। কিন্তু লুবনার যেন কোন চেতনাই ছিল না। লুবনার ভাই যখন কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন, ঠিক তখনি, মৌনতার দেয়াল চিড়ে ফিরে এলো ফিরে এলো লুবনা নির্মম এ বাস্তবতায়-

লুবনা তার ভাইকে জড়িয়ে ধরে বারবার শুধু বলতে লাগলো- ভাইয়া সুখ রাজ্যের সুখ আমার জন্য না আমার জন্মটাই একটা অভিশাপ। আমার ভাগ্যে যে সুখ সৃষ্টিকর্তা লিখেননি সে সুখ তোমরা বারবার আমার জন্যে কিনতে গেছ ভাইয়া। আমি কি পাপ করেছি? কি আমার অপরাধ? কেন আমায় এত অসাধারণ উপাদানে গড়লেন বিধাতা, জীবনের অসাধারণ উপাদানের তালে আজ আমি সম্পূর্ণ নুয়ে গেছি ভাইয়া। আমিতো শুধু একটু ভালোবাসা একটু সোহাগ খুঁজেছিলাম স্বামী নামের ঐ মানুষ দুটোর কাছে। সব ভুল মানুষ গুলো কেন বারবার আমার সহজ ভালোবাসার সাথে এভাবে প্রতারণা করলো? আমি আজন্ম এক অভিশপ্ত কপাল নিয়ে পৃথিবীতে এসেছি। 

ভাবী লুবনার পা ধরে ক্ষমা চাইল, ‘আমার জন্যই তোমার এ অবস্থা, তুমি আমায় ক্ষমা করো লুবনা, তুমি আমায় ক্ষমা করো’ বিধ্বস্ত লুবনাকে বার বার কেঁদে বলল ভাবী কথা গুলো। 

‘আমায় আর পাপের ভাগী করনা ভাবী। তুমি বা তোমরা কেউই আমার এ দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী নও: তোমরা তো সারাক্ষণ আমার মঙ্গল কামনা করো তা আমি জানি।’ ভাবীকে বুকে জড়িয়ে লুবনা বলল।

রুবী ভাই ভাবীকে সামলিয়ে বসানোর চেষ্টা করতেই রুবেল বলল, আপনারা সবাই তো ভালোই চেয়েছিলেন, কে জানত বলেন, ভদ্র চেহরার অন্তরালে এতো বদমাশি, এতো নোংরামী আছে। আজকাল কে কার ভেতরের খবর রাখে বলেন? আর মানুষ যে এখন কত মুখোসের অন্তরালে বাস করে তা শুধু বিধাতাই জানে। লুবনাকে আমরা আমাদের সর্বস্ব দিয়ে সামাল দিব, লুবনার জন্য সবাই আছে, লুবনার মত মেয়ে সবার ভাগ্যে জোটে না। ওরা বদ্নসিব ওরা হীরার টুকরা এই লুবনার মূল্য বুঝল না। লুবনাকে সামাল দেয়ার লোকের অভাব কোনদিনই হয়নি, হবেও না। আমরা লুবনার জন্য নতুন কিছু ভাববো, লুবনার জন্য ছেলের অভাব কখনো হবে না।

রুবেলের কথা শেষ হতে না হতেই অগ্নিমুর্তি ধারণ করে লুবনা সজোরে বলে উঠলো, ‘আমি কি খেলার পুতুল, আর কতবার তোমরা আমার এ জীবনটা সুখ বাজারের নিলামে উঠাবে? আর কত? আমি ভেঙ্গেছি, কিন্তু কত হাজার টুকরো হয়েছি, তা তোমরা কেউ জান না, তোমরা সুখ দিতে যেয়ে কত দুঃসহ দুঃখ যে আমায় দিয়েছো তা শুধু আমিই জানি। খবরদার আমাকে আর কেউ সুখ দেয়ার অপচেষ্টা করবে না। যার ভাগ্যে সুখ হয়না, তার কোনদিনও হয়না- আমি বড্ড ক্লান্ত। তোমাদের দেয়া সুখ আমি আর চাই না- রক্ত চক্ষু চাহনিতে সবার সামনে হাওয়ার বেগে দৌঁড়ে বেলকনি থেকে লাফ দিল লুবনা। সবাই লুবনার পিছু দৌঁড়িয়েও ঠেকাতে পারলো না কেউ। বেলকনি  থেকে এক্কেবারে রাস্তায় রক্তাক্ত। ছয়তলা থেকে মুহূর্তেই লিফটে নামলো সবাই। ডাঙ্গায় তোলা মাছের মতো ছট্ফট্ করতে থাকা লুবনাকে ভাই কোলে নিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলো- এ তুই কি করলি লুবনা এ তুই কি করলি?

লুবনা অস্পষ্ট স্বরে ভাইকে জড়িয়ে বলল, যার হয়না কখনো হয়না ভাইয়া।

হাতে মেহেদীর রং রক্তের লালে ম্লাান হয়ে গেল- সবাই যেন পাথর হয়ে গেল-

কি হতে কি হয়ে গেল লুবনাকে শক্ত করে বুকে চেপেই রইলো ওর ভাই- মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো হতভাগি লুবনা- আকাশ বাতাস সব যেন মাতম করতে লাগলো- কান্নার সুরে করুণ এ মৃত্যু দেখে।





সমাপ্ত


কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.