Header Ads

স্বপ্ন নিবাস

 

লিখেছেন- মোঃ এনামুল হক


হঠাৎ টেলিফোনের কর্কশ আওয়াজে মেছের সাহেবের ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখে মুখে একরাশ বিরক্তির আভা নিয়ে রিসিভারটা কানের কাছে নিল। কি যেন একটা সংবাদ শুনে তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো। নিজেই ড্রাইভ করে সরাসরি চলে আসলো স্বপ্ননিবাসে। 

মেইনগেটে গাড়িটি রেখে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল তার মায়ের কক্ষের দিকে। মেঝেতে শোয়ানো মায়ের মৃতদেহটা দেখে বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো। 

চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করলো কিন্তু অপরাধবোধের পাল্লাটা এতটাই ভারী ছিল যে, তার কণ্ঠস্বরের আওয়াজটা রোধ করে দিল। মৃত মায়ের পাশে বসে মেছের সাহেব যখন কাঁদতে ছিল, হঠাৎ তার নজর পড়লো মায়ের হাতের মধ্যে লুকানো একটি চিঠির দিকে। মেছের সাহেব আলতোভাবে চিঠিটা এনে খুলে পড়তে লাগলেন-

কেমন আছো? বাবা। অনেকদিন হয়ে গেল তোমার মুখখানী দেখিনা। সেই যে স্বপ্ননিবাসে রেখে গেলে, আর এলে না। কতদিন জানালার ধারে গিয়ে বাইরের ঐ পথটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এই বুঝি আমার মানিক এসে আমাকে নিয়ে যাবে।

কিন্তু তুমি একটিবারের জন্যও আসলে না। হয়ত আর কখনও আসবে না। তাই তোমার জন্য এই এক টুকরা কাগজ রেখে গেলাম, যদি সময় পাও পড়ে নিও। কয়েকদিন হলো শরীরটা খুব ভালো যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে মৃত্যু আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। খুব ইচ্ছে করছে দাদুভাইকে একটিবার দেখার। মনে হয় সে আশাটুকু ও আমার পূরণ হবে না। 

সময়ের নিষ্ঠুরতা তোমাকে আমার কাছ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছে। অথচ কয়েকটা বছর আগেও তুমি আমাকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারতে না। তোমার কি সেই ছোট্ট বেলার কথা মনে পড়ে? তুমি আমি প্রায়ই লুকোচুরি খেলতাম। আমি যখন লুকিয়ে থাকতাম, তখন তুমি আমাকে না পেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠতে। 

তখন দৌড়ে এসে তোমাকে বুকে জড়িয়ে ধরতাম। আর তুমি বলতে মা তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। দেখে নিও আমি বড় হয়ে তোমার জন্য আকাশ থেকে লিটল স্টার এনে দেব। এখন বুঝি আমার কথা আর মনে পড়ে না, বাবা। আমার বুকের মাঝে মুখ না লুকালে কখনো ঘুমাতেই পারতে না। শত ব্যস্ততার মাঝে তোমাকে না খাইয়ে দিলে ভাত খেতে না। এখন বোধ হয় এমনটি আর হয় না।

বাবা, তোমার কী সেই পাঁচ বছর বয়সের কথা মনে পড়ে? হঠাৎ করেই তুমি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লে। তোমাকে পাগলের মত জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। সেদিন মনে হচ্ছিল, এই বুঝি আমার কলিজাটা আমার বুকের মধ্যে থেকে কেউ ছিড়ে নিচ্ছে। সারারাত তোমাকে বুকের মধ্যে আগলে রাখলাম আর খোদার কাছে এই প্রার্থনা করলাম -হে আল্লাহ! আমার কলিজার টুকরা আমার মানিককে আমার কোল থেকে কেড়ে নিও না।

তোমার বয়স যখন ছয় হলো তখন একটি রোড এক্সিডেন্টে তোমার বাবা মারা গেলেন। তখন থেকেই দারিদ্রের সাথে যুদ্ধ করে বাঁচতে শুরু করলাম। কখনও ঝিয়ের কাজকখনও বা সেলাইয়ের কাজ, কখনো কখনো স্কুলে ধোয়া মোছার কাজ করে তোমার স্কুলের খরচ যোগাতাম। তুমি আঙ্গুর পছন্দ করতে তাই প্রায়ই সংসার খরচ থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে আঙ্গুর কিনে আনতাম। এভাবে আমার জীবনের অনেকটা সময় কেটে গেল তোমাকে লেখাপড়া করাতে। 

লেখাপড়া শেষ করলে। ভালো একটা চাকরি পেলে, গর্ব করে সবার কাছে বলতাম-আমার মানিক অফিসার হয়েছে। তখন মনে হচ্ছিল আমি পেরেছি। আমি তোমাকে মানুষের মত মানুষ করেছি। এক বুক আশা নিয়ে বছর দুয়েক পরে বউমাকে ঘরে আনলাম। বড্ড ইচ্ছে ছিল সবাই মিলে একসাথে সুখে-শান্তিতে বসবাস করব। 

কিন্তু সেই ইচ্ছাটা আমার পূরণ হলো না। দুমাস পর থেকেই বউমার নিষ্ঠুরতা ক্রমাগত বেড়েই চলল। একজন বৃদ্ধাকে তাদের ঘরের আবর্জনা মনে করে বহুবার ডাস্টবিনে ফেলে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সমাজের দায়বদ্ধতার কাছে বারবার হেরে গিয়েছিল। তাই বলে মানসিক নির্যাতন কম করলে কী আর চলেডাইনিং রুমের মেঝেটা ছিল আমার শোবার ঘর। মোটা একটা তোষকের অভাবে প্রায়ই আমার ঠাণ্ডা লেগে যেত। 

কারণে আমার দাদু ভাইকে আমার কাছে আসতে দিত না। খাবার দেওয়ার জন্য বরাদ্দ ছিলো দশ বছরের পুরোনো একটা মেলামাইন প্লেট ও একটি স্টিলের মগ। খাবার বলতে যা আমার ভাগ্যে জুটতো তা ছিল খাবারের উচ্ছিষ্ট। পরনে দুটো মোটা তাঁতের কাপড় ছাড়া কিছুই জোটেনি। অসুস্থ হলে যাতে খরচ কম লাগে তাই ঘরোয়া চিকিৎসাতেই সন্তুষ্ট থাকতো সে। তুমি বড় অফিসার, তাই তোমাকে অনেক কাজ করতে হয়। মায়ের খোঁজখবর নেওয়ার মত কোন সময় তোমার নেই। 

তাছাড়া যতটুকু সময় ছিলো তা তোমার সন্তান বউয়ের জন্য যথেষ্ট ছিল না। প্রায়ই তুমি বউ এর কথায় আমাকে গালমন্দ করতে। কিন্তু বাবা বিশ্বাস কর এতোটা দোষ আমি করতাম না। একদিন তুমি বউ এর কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে আমার চুলের মুঠি ধরে দরজার বাইরে ফেলে দিলে। দেওয়ালের আঘাতে আমার কপালের খানিকটা কেটে গিয়ে রক্ত ঝরতে লাগলো। প্রতিবেশীদের দয়ায় সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলাম। 

জানো বাবা, সেদিন আমার কলিজায় যে, রক্তক্ষরণ হয়েছিলো তা আজও বন্ধ হয়নি। তোমার সংসারে আমার উপস্থিতি যখন সহ্যের সীমা ছেড়ে গিয়েছিলোতখনই তুমি বউমার অনুরোধে আমাকে এই স্বপ্ননিবাসে নিয়ে আসলে। 

এখানে খাওয়া-দাওয়া চিকিৎসা সব কিছুই ভালো। তবু কোথায় যেন একটা শূন্যতা বিরাজ করে। এটা হয়ত বা তোমাদের না দেখার শূন্যতা। তোমাদের কাছে পাবার শূন্যতা। বাবা, আমার দাদু ভাইটাকে তুমি সুশিক্ষায় শিক্ষিত করো। যা আমি তোমাকে করতে পারিনি। আমি চাই না আমার মত তুমিও কষ্ট পাও। তোমাকে অনেক কিছু লিখলাম।

হয়ত বা তোমার অনেক সময় নষ্ট হয়ে যাবে। কষ্ট করে পড়ে নিও। হয়ত বা চিঠির কয়েকটা অক্ষর পড়তে অসুবিধা হবে, কারণ নিজের অজান্তেই চোখের জলটা অক্ষরগুলোকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। বাবা, আমার জীবনের একটা শেষ ইচ্ছা পূরণ করলে বড়ই কৃতজ্ঞ থাকবো। আমার মৃত্যুর পর তোমার বাবার পাশে আমাকে কবর দিও।

জীবনের এই শূন্যতার মাঝে বার বারই তোমার বাবাকে মনে পড়ছে। হয়ত বা পরজনমের একটু শান্তি আমি সেখান থেকেই খুঁজে নেব। আর একটা কথা আমার হাতের এই বালা দুটি বিক্রি করেই আমার দাফনের ব্যবস্থা করবে। এটুকুই তোমার কাছে আমার শেষ চাওয়া। আর বউমাকে বলিও আমি সারাক্ষণ সবার জন্য দোয়া করেছি। 

আল্লাহ তোমাদের সকলের মঙ্গল করুন।

ইতি তোমার হতভাগা

মা।

চিঠির পাতাগুলো পড়ে মেছের সাহেবের চোখ দুটো জলে আরো পরিপূর্ণ হয়ে গেল।

জানি না জল অনুতাপ, না বেদনার, না কষ্টের।


কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.