শোভনার চারুচন্দ্র বোস
আর একজন টিংকু
-
বিশ্বাস মিলি
ফার্স্ট ইয়ারে পড়তো টিংকু। কতই বা বয়স। এই ধরো ১৬ বছর হতে পারে টেনে টুনে। খুলনার সিটি কলেজে পড়াশুনা করতো সে। যদিও কলেজের এখনকার নাম সরকারি মজিদ মেমোরিয়াল সিটি কলেজ কিন্তু খুলনার সাধারণ মানুষ জানে সিটি কলেজ হিসেবে। দুষ্টের শিরোমনি বলতে যা’ বোঝায় টিংকু ছিল তা’।
এইটুকু বলেই থামলেন ছালাম চাচা। এবারের ২৬শে মার্চে উমেশচন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে স্কুল পড়–য়া শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাচ্ছিলেন তিনি। গল্প বলতে গিয়ে এভাবেই কাহিনীটা শুরু করেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম, সবার প্রিয় ছালাম চাচা।
- আমি ওকে জন্ম থেকেই চিনতাম। শফিক সাহেবের একমাত্র ছেলে। তখন খুলনা এ্যাত্তো বড় মহানগর হয়ে ওঠেনি। ছোট্ট সাজানো গোছানো একটা শহর। কালেক্টরি, জিপিও, এসপি অফিস, হাসপাতাল, জেলখানা, ফায়ার ব্রিগেড, সার্কিট হাউস, থানা, পার্ক, স্টেডিয়াম- সব কাছাকাছি। যেন যা’ দরকার দু’ পা’ হেঁটেই পাওয়া যেতো সব। আর খুলনার প্রাণকেন্দ্র বলতে যা’ বোঝায় তা’ ছিল পিকচার প্যালেস মোড়। আশিয়ানা হোটেল, ডিলাক্স হোটেল খাওয়ার জন্য আর হোটেল সেলিম থাকার জন্য সবচেয়ে নামকরা ছিল তখন। আর মিষ্টির দোকান হিসেবে খ্যাতি ছিল বড় বাজারের ওয়েস্ট মেকট রোডের নিরাপদ ঘোষ।
শফিক সাহেবরা বড় মীর্জাপুর থাকতেন। ফাঁকা ফাঁকা ঘর-বাড়ী। প্রত্যেক বাড়ীতেই নানান ফুল ফলের গাছ। টিংকু সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতো এর বাড়ী ওর বাড়ী থেকে ঢিল ছুড়ে আম, জাম, বড়ই পেড়ে খাওয়া আর বাগান থেকে চুরি করে ফুল ছেঁড়ায় ব্যস্ত। ওর কাছে বই খাতার চেয়ে গুলতি, লাটিম, লাটাই-ঘুড়ি, মার্বেল অত্যন্ত প্রিয়। সে ফেলে দেয়া সিগ্রেটের প্যাকেট দিয়ে তাস খেলতো। তোমরা কি এখনো এ সব খেলা খ্যালো?
প্রশ্নটা সবার উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিয়ে আবারও বিরতি নেন ছালাম চাচা। ছোট ছোট সোনামনিরা বললো, তারা তাস খেলাটা জানে না। বাকি সব চেনে কিন্তু নিজেরা কখনো ব্যবহার করেনি।
- টিংকুর বিরুদ্ধে তার বাবার কাছে প্রায়ই নালিশ আসে। একমাত্র ছেলে হওয়া সত্বেও শফিক সাহেব বেশ কড়া শাসনে রাখতেন টিংকুকে। কিন্তু সে শাসন টিংকুকে দুষ্টুমি থেকে সরাতে পারেনি কখনো। তবে সে কিন্তু স্কুলে যেতো নিয়মিত। স্কুলে থাকাকালেও অবিরাম চলতো তার দুষ্টুমি। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত এপিসি স্কুলে পড়াশুনা করে সে ক্লাস সিক্সে এসে ভর্তি হয় বিকে স্কুলে। বিকে স্কুলেই তার দুষ্টুমি চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। টিংকুর কারণে কি-না জানি না, বিকে স্কুলকে অনেকেই তখন বলতো, বান্দরের কারখানা।
- বিকে স্কুলে ক্লাস শুরু হওয়ার প্রথম দিনেই সহপাঠী আর শিক্ষকরা টের পেয়ে যান টিংকু কি জিনিষ! টিংকু তার এই স্কুলের প্রথম দিনেই ব্ল্যাকবোর্ডে পণ্ডিত স্যারের কার্টুন এঁকে, সামনের বেঞ্চের সহপাঠীদের জামায় ফাউন্টেন পেনের কালি ছিটিয়ে, একজনের সাথে মারামারি করে তার উপস্থিতি জানান দেয়। বেত হাতে করে হেডস্যারকেও ছুটে আসতে হয় টিংকুর জন্য। প্রথম দিন বলেই বেতের বাড়ি থেকে মাফ পেয়ে যায় টিংকু। হেডস্যার জন স্যারকে নির্দেশ দেন তিনি যেন টিংকুকে সব সময় নজরে রাখেন।
- পরদিন এ্যাসেব্লিতে টিংকুকে ডাকা হলো জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার জন্য। যথারীতি সাফল্য দেখালো টিংকু। অবলীলায় গেয়ে গেল “পাক সার জামিন সাদ বাদ/ কিসওয়ারে হাসিন সাদ বাদ/ তু নিশানে আজমে আলী শান..................”। থামেন ছালাম চাচা। স্পিচ ডায়াসে রাখা পানির বোতলের ছিপি খুলে দু’-তিন ঢোক পানি খেয়ে নিয়ে আবারও বলতে শুরু করেন-
এতো গেল তার স্কুলজীবনের গল্প। এবারে মূল কাহিনীতে মানে তার কলেজ জীবনের ঘটনায় আসি। কলেজে ওঠার পর দুষ্টুমি আরও বেড়ে যায় টিংকুর। এখানেও সবাই জেনে যায় টিংকুর নাম। কলেজে সেদিন প্রথম ক্লাসটি বাংলা থাকলেও সুনীল স্যার অসুস্থতার কারণে স্কুলে গরহাজির থাকায় ইতিহাসের পরিমল বাবু ক্লাসে এলেন। তিনি ইতিহাস পড়ান।
- পরিমল বাবুও জেনে গিয়েছিলেন টিংকুর কথা। তিনি প্রথমেই জানতে চাইলেন, টিংকু কে? টিংকু উঠে দাঁড়ালো। পরিমল বাবু তাকে বসতে বলে ক্লাস শুরু করলেন। ‘তোমরা সবাই জানো, আমাদের দেশ পূর্ব পাকিস্তান।’ এক সময় এই দেশটি শাসন করতো বাঙালিরা। তারপর মোগলরা দীর্ঘদিন ধরে এ দেশ শাসন করেছে। রাজা বা নবাবরা মোগলদের কর পরিশোধের মাধ্যমে এ দেশ শাসন করতো। এর পরে ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশরা এ দেশ দখল করে নেয়। আর প্রায় দু’শ’ বছর ধরে সাদা চামড়ার মানুষগুলো আমাদের উপর শোষণ, শাসন, নির্যাতন চালায়।
পরিমল বাবু বলে যান, আজ যে দেশটা পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত সেই দেশের মানুষ বাংলায় কথা বলে। তারা চিরকাল সব জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের প্রিয় শহর খুলনা এবং এই খুলনা জেলার মানুষেরও রয়েছে সংগ্রামের ইতিহাস। এই জেলার মানুষও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম করেছে, জীবন দিয়েছে, ফাঁসিতে ঝুলেছে। আর তার বিনিময়েই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি।
পরিমল বাবু বলেন, আজ তোমাদের শোনাবো এই খুলনা জেলার একজন মহান সংগ্রামীর কথা। তোমরা কি শোভনা নামের কোন গ্রাম চেনো? পরিমল স্যারের প্রশ্নের উত্তরে কয়েকজন হাত তোলে। তাদের সবার বাড়ীই ডুমুরিয়ায়। তারা বললো যে শোভনা ডুমুরিয়া থানার একটা গ্রাম। ঐ গ্রামটি যে ইউনিয়নে অবস্থিত তার নামও শোভনা।
- আচ্ছা, শোভনার কোন সংগ্রামীর নাম বলতে পারবে? সবাই চুপ। পরিমল বাবু বলেন, সেই সংগ্রামী মানুষটার নাম চারুচন্দ্র বসু। ১৮৯০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চারুচন্দ্র বসু জন্মগ্রহণ করেন খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার শোভনা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম কেশবচন্দ্র বসু। চার ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয় চারু বসু জন্মগত শারীরিক প্রতিবন্ধী ছিলেন। তাঁর ডান হাতটি ছিল হাঁসের পায়ের পাতার মতো মোড়ানো। খর্বকায়, অসুস্থ, ছিপছিপে পাতলা দেহগড়নের এই তরুণ স্বভাবে ছিলেন বুদ্ধিদীপ্ত, ক্ষুরধার ও প্রতিবাদী।
স্বাধীনতা আন্দোলনের সেই অগ্নিগর্ভ দিনগুলোতে সারা ভারত জুড়ে বিপ্লবীদের বীরত্বপূর্ণ কর্মকান্ডে ইংরেজ সরকার ভীষণভাবে ব্যতিব্যস্ত। জীবনের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের অগ্নি শপথে বলিয়ান বাঙালি তরুণ যুবকের দল বৃটিশ সরকারের উপর নানাভাবে চোরাগুপ্তা হামলা চালিয়ে তাদেরকে তটস্থ করে রেখেছিল। একই সঙ্গে ইংরেজদের অনুগত বাহিনীর দমন-পীড়ন এবং তাদের কিছু এদেশীয় দোসরদের অপতৎপরতা সমানভাবে বাড়তে থাকে।
পরিমল বাবু বলেন, এখরকার ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আলীপুর ও মুরারীপুকুর বোমা হামলাসহ অন্যান্য মামলায় ইংরেজ সরকার পক্ষের উকিল ছিলেন আশুতোষ বিশ্বাস। তিনি সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন বিপ্লবীর শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহের সহায়তা করতেন। বৃটিশ সরকারের একনিষ্ঠ সমর্থক এই আইনজীবী নিজেই আগ্রহী হয়ে তার দাপ্তরিক কর্মের বাইরে গিয়েও স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে বৃটিশ পুলিশকে বিভিন্ন রকম সহায়তা দিয়ে যেতো স্বদেশী আন্দোলনকারীদের ধরার জন্য।
আশু উকিলের এই জঘন্য কর্মকা-কে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে স্বাধীনতা বিরোধী ভূমিকা হিসেবে পরিগণিত হয়। তাঁরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন কুখ্যাত বৃটিশ-দালাল আশু উকিলকে হত্যা করা হবে। স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যুবক চারু বসু সানন্দে এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
সেদিন যেন কথায় পেয়েছিল পরিমল স্যারকে। তিনি বলে যেতে থাকেন- চারু বসু তাঁর পঙ্গু ডান হাতে খুব শক্ত করে রিভলবার বেঁধে নিয়ে গায়ে চাদর জড়িয়ে আলিপুর আদালত প্রাঙ্গণে যান। দিনটি ছিল ১৯০৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। উপযুক্ত সময়ের জন্য তিনি অপেক্ষা করেছিলেন। বিকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর আদালতের পশ্চিম পাশে তিনি তাঁর লক্ষ্যবস্তু আশু উকিলকে পেয়ে যান এবং সঙ্গে সঙ্গে বাম হাত দিয়ে ট্রিগার চাপেন। আক্রান্ত ব্যক্তি চিৎকার করতে করতে দ্রুত দৌড়াতে থাকেন।
চারু বসু আবার গুলি করেন এবং ঘটনাস্থলেই মারা যান আশু উকিল। ততক্ষণে সুরক্ষিত আদালত প্রাঙ্গণে চারু বসু পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। চারু বসুর বিয়ের দিন ঠিক হয়েছিল ৮ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু হবু স্ত্রীকে স্বাধীনতা সংগ্রামের কঠিন পথে চলার কথা বলে বিয়ের নির্ধারিত দিনের আগেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। ১০ ফেব্রুয়ারি জানা গেল সরকারি উকিল আশু বিশ্বাসকে হত্যা করেছেন সেই ঘর পালানো তরুণ চারু বসু।
পরিমল স্যার বলতেই থাকেন- বৃটিশ সরকার চারু বসুকে গ্রেফতার করে তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করে। তাঁকে গ্রেফতার করা গেলেও তাঁর মুখ থেকে অস্ফুট হাসির রেখাটিকে কখনও দমন করা যায়নি। বিপ্লবীদের সম্পর্কে তথ্য বের করার জন্য জেলখানায় তাঁর উপর ভয়ানক রকম অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল। শারীরিক প্রতিবন্ধী চারু বসু সেই নির্মম শারীরিক নির্যাতন মুখ বুঁজে সহ্য করেছেন। কিন্তু তাঁর সহকর্মী এবং সংগঠন সম্পর্কে একবিন্দু তথ্য তিনি মুখ থেকে বের করেননি। শারীরিক দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও তিনি কোন রকম অনুকম্পা প্রার্থনা না করে বরং সর্বদা নিজের আদর্শের প্রতি সুগভীর আস্থা রেখেছিলেন।
পরিমল স্যার ক্লাসে আরও বললেন, চারুচন্দ্র বসুর বিরুদ্ধে তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯০৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি। পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ বাম্পসকে লক্ষ্য করে চারু বসু বলেছিলেন, ‘না কিছুই আমি চাইনে। সেশন-টেশনের প্রয়োজন নেই। বিচার করে কালই আমাকে ফাঁসি দাও। এটা ভবিতব্য যে, আশু বাবু আমার গুলিতে নিহত হবেন এবং আমি ফাঁসি কাঠে প্রাণ দেব।’ আদালতের কার্যবিবরণী শেষ হয় ১৯০৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি।
মামলার বিচারে তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুর সাজা দেওয়া হয় এবং ঠিক তার পরদিনই তাঁর মৃত্যুদণ্ডের কথা শোনানো হয়। তিনি তা দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য বলেন। দোসরা মার্চ তাঁর বিচার হাইকোর্টে তোলা হয়। ১৯০৯সালের ১৯ মার্চ আলীপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে এই মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী শতভাগ দেশপ্রেমিক মৃত্যুঞ্জয়ী বিপ্লবীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।
এইটুকু বলে থামলেন পরিমল স্যার। তারপর জানতে চাইলেন, তোমাদের ভেতর এমন কেউ কি আছে, যে দেশের জন্য, এই দেশের মানুষের মুক্তির জন্য এমন আত্মবলিদান করার সাহস রাখো? অধোবদনে একটা ছেলে উঠে দাঁড়ায়, ছেলেটির নাম টিংকু। পরিমল স্যারের ক্লাস শেষ হয়ে যায়। সবাই হৈ গৈ করে বের হয়ে যায় ক্লাস থেকে। একটা ছেলে তার আসনেই বসে থাকে নির্বাক হয়ে চোয়াল শক্ত করে। ছেলেটির নাম টিংকু।
তারপর কি হলো, ছালাম আঙ্কেল? শুধায় উমেশচন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে স্কুল পড়–য়া ক্ষুদেরা। সবাই ছালাম চাচার মুখ থেকে তন্ময় হয়ে শুনছিল পরিমল স্যারের সেদিনের ক্লাসের সেই পাঠ। বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম আবারও বলতে শুরু করেন-
- সেদিন থেকেই আমুল পরিবর্তন টিংকুর। পাড়ার লোকেরা অবাক হয়! তাদের গাছে, টিনের চালে আর কেউ ইট মারে না। পাড়াতেই দুরন্ত ছেলেটাকে আর পাওয়া যায় না! কি হলো ছেলেটার? টিংকুকে এখন নিয়মিত পাওয়া যায় সার্কিট হাউস মাঠ বা হাদিস পার্কের সমাবেশ বা জনসভায়। মিছিলের শ্লোগানে তার কন্ঠ ছাপিয়ে যায় অন্যদের। এর মাঝেই এসে গেল একাত্তুরের মার্চ। তেসরা মার্চ জন্মদিন ছিল ওর। ষোল বছর বয়স পুরে যাওয়ার কথা। সেই সময় এখনকার মত ঘটা করে জন্মদিন পালনের রেওয়াজ ছিল না। তবু শফিক সাহেব ভাল-মন্দ রান্না করে ফকির মিসকিনদের খাওয়ালেন দুপুরবেলা। কিন্তু সেখানেও পাওয়া গেল না টিংকুকে।
টিংকু তখন প্রতিবাদ মিছিলে। মিছিলটা ছিল বিশাল। সার্কিট হাউস থেকে মিছিলটা বের হয়। যশোর রোড দিয়ে চলা মিছিলের মাথা যখন পিকচার প্যালেসের মোড় ছাড়াচ্ছে তখনও মিছিলের লেজ সার্কিট হাউসে। মিছিলের সামনের ভাগে ছিল টিংকু। আজ সে নিজেই শ্লোগানে মূল কন্ঠ দিচ্ছিল। হঠাৎ স্টেট ব্যাংক মানে এখনকার বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতর থেকে গুলি চললো মিছিল লক্ষ্য করে। মানুষের চিৎকার, হুড়াহুড়ির মধ্যে কোনমতে দৌড়ে নিজের পাড়ায় পৌঁছায় টিংকু। পরে জানা যায় মুসা সহ তিনজন শহীদ হয়েছেন গুলিতে।
এর মধ্যে কেটে গেল আরো কিছু দিন। শুরু হলো মুক্তির জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ। আমরা তখন যুবকদের সংগঠিত করছি। আমাদের সাথে মুক্তিকামী খুলনার অসংখ্য মানুষ। অপেক্ষা করছি নির্দেশনা পাবো নেতাদের কাছ থেকে। তারপর ঝাপিয়ে পড়বো পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে। রাতের বেলা কার্ফ্যু আর দিনের বেলা কয়েক ঘন্টার জন্য চলাচল করার সুযোগ।
এর ভেতর আমরা একে একে শহর ছাড়তে শুরু করলাম। আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী রাতের বেলা প্রধান রাস্তা ছেড়ে বিলের ভেতর দিয়ে পায়ে হেঁটে বটিয়াঘাটা থানার কৃষ্ণনগরে বিলের ভেতর মিলিত হলাম আমরা। পাকিস্তানী মিলিটারি এলে আমরা কমপক্ষে এক মাইল দূর থেকেই তাদের গাড়ীর আলো দেখে সটকে পড়তে পারবো।
কৃষ্ণনগরের বিলে রাত ১২টার মধ্যেই কয়েক হাজার মানুষ হাজির হলাম। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হলো যে, রাতের বেলা বিল পাড়ি দিয়ে আমরা ডুমুরিয়ার চুকনগর গিয়ে পৌঁছাবো। সেখানে আমরা বিভিন্ন বাড়ীতে আশ্রয় নিয়ে রাতে আবার পথ চলা শুরু করবো। এভাবে দিনের বেলা আশ্রয় আর রাতে পথ চলে যত শিগগীর সম্ভব পৌঁছে যাব মুক্তিবাহিনীর রিক্রুট ক্যাম্পে।
আমরা যখন চুকনগরে পৌঁছাই তখন সকাল হয়ে গেছে। হঠাৎই দেখতে পেলাম টিংকুকে। অতটুকু বাচ্চা ছেলে আমাদের মত যুবকদের সাথে পাল্লা দিয়ে সারা রাত ধরেই পথ চলেছে সে। এখন তাকে বাড়ী ফিরে যেতে বললে বিপদে পড়তে পারে সে। তবুও তাকে ফিরে যেতে বললাম। কিন্তু সে কথা শুনলো না। আমাদের সাথেই পা মেলালো সে। তার চোখে বিদ্রোহের আগুন, মুষ্টিবদ্ধ হাতে শপথের দৃঢ়তা আর মুখে দীপ্ত প্রত্যয় দেখে আমাদের দলনেতা তাকে দলে রেখে দিলেন।
এভাবে কেটে গেল আরও বেশ কিছু লম্বা রাত। পায়ে হেঁটেই সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী এলাকায় পৌঁছে গেলাম আমরা। রাতের আঁধারে ছোট্ট সীমান্ত নদী পার হতে হবে সাঁতরে বা নৌকায় চড়ে। এলাকাবাসীরা বললেন, কোন সমস্যা হবে না। পাকিস্তানী মিলিটারিরা এ এলাকায় এখনো ঢোকেনি।
আমাদের ভেতর যারা সাঁতার জানে তারা সাঁতরেই নদী পার হলো। আর যারা সাঁতার জানে না তারা নৌকায় চড়ে পার হচ্ছে। নৌকার সংখ্যা কম থাকায় ছোট ছোট দলে নৌকা পার হতে হচ্ছিল। খুলনা থেকে আসার পথে আমরা বেশ কিছু অস্ত্র এবং গুলি সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম। পথে শত্রুর মোকাবেলা করা লাগতে পারে ভেবে ওগুলো নিয়েই পথ চলছিলাম আমরা।
সীমান্ত পার হওয়ার সময় সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো অস্ত্র এবং গুলি যাবে সব শেষ নৌকায়। যদি কোন আক্রমণ আসে তা’ হলে মোকাবেলার জন্য শেষ পর্যন্ত লড়ার রসদ থাকবে। গ্রামের মসজিদে যখন ফজরের আযান চলছে তখনো ২৫-৩০ জন পারের অপেক্ষায়।
এই সময় খুব কাছ থেকে হঠাৎ গুলির আওয়াজ। নিজেকে আড়াল করার তেমন কোন কিছু চোখে পড়লো না। এই সময় সাঁতার না জানা টিংকু একটা দোনলা বন্দুক তুলে নিল নিজ হাতে। নলটা ভেঙে দু’টো গুলি ভরে ফেললো অবলীলায়। আর কিছু গুলি ওর হাফ প্যান্টের পকেটে ভরে নিল। আমি জানতাম ওর বাবার বন্দুক আছে, কিন্তু জানতাম না ও বন্দুকে গুলি ভরতে এবং চালাতে জানে।
টিংকু বললো, আপনারা সবাই নৌকায় উঠে যান। এ গুলি যদি শত্রুপক্ষের হয় তা’ হলে ওদের দু’ চারটেকে শেষ করার আগে আমি যাব না। আর যদি এ গুলি আমাদের পক্ষের হয় তা’ হলে পরের নৌকায় ওদের সাথে আমি আসছি। এই বলে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ও দৌড় লাগালো। আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব কিছু ঘটে গেল। এরই মাঝে পাঁচটা নৌকা ঘাটে ফেরৎ এসেছে আমাদের নিতে। মাঝিরা তাড়া দিচ্ছে নৌকায় ওঠার জন্য। মন থেকে না চাইলেও নৌকায় উঠতে হলো।
আবার গুলির শব্দ। এবারে গুলির শব্দ খুব কাছ থেকে। মাঝিরা প্রাণপণে নৌকা বাইছে। দিনের আলো ফুটে উঠেছে ততক্ষণে। মাঝ নদী থেকে দেখতে পাচ্ছি ৫/৭ জন খাকি পোশাকধারী গুলি করতে করতে ছুটে আসছে নদীর দিকে। ওরা আমাদের দেখতে পেয়েছে। নৌকা লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে শুরু করলো হানাদারেরা। পাড়ে প্রায় পৌঁছে গেছি। এমন সময় আবারও গুলি।
দেখলাম খাকি পোশাকের দুজনকে লুটিয়ে পড়তে। এবার মুষলধারে গুলি ছুটতে শুরু হলো। আমরা সবাই নিরাপদেই ভারতের মাটিতে পা’ রাখলাম। তুমুল গুলির ভেতরই নদীর ওপার থেকে শুনতে পেলাম এক কিশোরের গগণবিদারি আওয়াজ, “জ য় বাং লা”।
#
কোন মন্তব্য নেই