Header Ads

আকিব শিকদার



রক্তফিনকীস্নাত সবুজ জামা


ভালবাসার জন্য মানুষ কী না পারে-

কী  না পারে বলুন?

সাত সাগর তেরো  নদী পার!

হোহ... সে তো 

সামান্য, ফুলের রেণুর মতো যৎসামান্য।


হানাদার বাহিনীর হাতে 

ধরা পড়েছিল একজন

সোনার মানুষ, মুক্তিকামি সোনার মানুষ।

শত অত্যাচার, তবু

মুখ খুললো না সাহসী সে তরুণ।

যদিও বেয়নেটের খোঁচা 

লাগছিল উরুতে, বুকে স্টেনগান ধরা

মুখের উপর কটু প্রশ্ন-

‘আমাদের জিজ্ঞাসার 

জবাব চাই, অগত্যা গুলি করে মারবো তোমায়।’

চূড়ান্ত নির্ভীক বলে, বুকভরা 

খাসা দেশপ্রীতি ছিল বলে-

নিচু হয়ে চুমু খেল

স্বদেশের মাটিকে, প্রেয়সীর গালে শেষ চুম্বনের মতো।

তারপর উঠে দাঁড়ালে

সটান, ঝাকড়া চুলের বাবরি নাড়িয়ে বল্লে-

‘যথেষ্ট প্রস্তুত আছি, আমার রক্ত

প্রিয় দেশটাকে দেবে স্বাধীনতা’।


বাতাসের কলরব

থামলো হঠাৎ। ছিঁড়ে গেল মালার আদলে ওড়া

পাখিদের ঝাঁক; ভিজে গেল ঘাস, শ্যামল মাটি।

ভেজা পতাকার মতো

রক্তফিনকীস্নাত সবুজ জামা, আর

নক্ষত্ররূপী জ্বলজ্বলে জামার বোতাম। 

..........................................................................................

পরাজয় কালগ্রাসে, এসেছে বিজয় 


পরাজয় উড়ে গেছে-

হালকা হাওয়ায় শুকনো হলুদ পাতার মতো। 

হঠাৎ দমকা ঝড়ে বাবুই পাখির নীড়ের মতো 

কায়ক্লেশে উড়ে গেছে পরাজয়-

সোনালি চিলের পরিত্যক্ত পালক যেমন।

নাটাইয়ের টানে ফেরা ঘুড়ির মতো 

সমুদ্রের তীরে ফেরা তরীর মতো 

বাংলার ঘরে ঘরে এসেছে বিজয়।


পরাজয় ফিরে গেছে-

ক্ষীণপদে পুকুর পাড়ের শামুকগুলোর মতো। 

এক লাফে দেয়াল পেরিয়ে ধূর্ত শিয়ালের মতো 

সন্তর্পণে ফিরে গেছে পরাজয়-

নাকে গন্ধ শুঁকে অভিষ্ট লক্ষ্যে কুকুরেরা যেমন। 

বছরান্তে কাননে বাসন্তি ফুলের মতো

অমবস্যান্তে শুক্লাদ্বাদশি চাঁদের মতো 

বাংলার ঘরে ঘরে এসেছে বিজয়।


পরাজয় মরে গেছে-

ভুল করে এক ফোটা হন্তারক বিষ পানের মতো। 

গুলি খাওয়া পাখি, ডাঙায় তোলা মাছের মতো

কালগ্রাসে মরে গেছে পরাজয়-

গৃহিণীর চুলে সুগন্ধী তেলের গন্ধ যেমন। 

মৃত্যুঞ্জয়ী চিরসঞ্জিবনী লতার মতো

পূনর্জন্মা প্রভাতের রাঙা সূর্যের মতো 

বাংলার ঘরে ঘরে এসেছে বিজয়। 

..........................................................................................

রঞ্জু একটা হাতিয়ার...


মিছিলটা হয়েছিলো প্রায় তিনশো গজ লম্বা। টানা পাচ দিন খেটেখোটে 

লোক জড় করেছিলে। বিপক্ষ দলের সামনে ইজ্জত রাখা চাই। 

গলিটা দখলে নিয়ে সাজালে প্যান্ডেল। ঝাঝালো ভাষণে 

জনপদ কাপিয়ে স্বার্থক জনসভা।

নেতা তোমাকে কাছে ডেকে পরিপাটি চুলগুলো 

আঙুলে উলোঝুলো করে দিয়ে বললো- “বেটা বাঘের বাচ্চা, তোর মতো 

কেজো ছেলে আগে দেখিনি, একেবারে বিপ্লবী চে গুয়েভারা”।

তুমি বাহবা পেয়ে গলে গেলে রঞ্জু। বুঝলে না, ছোটদের বগলবন্দি রাখতে

বড়রা এমন প্রশংসার ফাঁদ প্রায়ই পাতেন।


পার্টি অফিসে প্রতিদিন কতো কাজ, কতো পরিকল্পনা। নেতারা তোমায় 

পিতার মতোই ¯স্নেহ করে। গোলটেবিল বৈঠকে 

জ্বালাময়ী আলোচনায় রক্ত গরম। 

বাঁধা এলে অস্ত্র নেবে, প্রয়োজনে প্রাণ দেবে। অফিসের গোপন ঘরে 

নেতারা গলা ভেজাতে ভেজাতে তোমাদের হাতে বুতল দিয়ে বলে- 

“নে বাবারা, খা... শুধু খেয়াল রাখবি যেন হুষ ঠিক থাকে”।

ভেবে দেখেছোকি রঞ্জু, তাদের ছেলেরা এসব নোংরা জল 

ছোবার কথা কল্পনাও করতে পাড়ে না। মায়েরা পড়ার টেবিলে 

গরম দুধে গ্লাস ভরে রাখে।


কালো কাচ আটা পাজারু গাড়ি থামলো রাস্তাতে। জানালার কাচ খুলে 

নেতা হাত বাড়িয়ে দিলেন হাজার টাকার দুটো নোট। বললেন- 

“রঞ্জু... ঝাপিয়ে পর বাবা, মান সম্মানের বেপার”।

তুমি ঝাপিয়ে পরলে পেট্রোল-বোমা আর ককটেল হাতে। দুদিন পর 

তোমার ঠিকানা হলো সরকারি হাসপাতালের নোংড়া বিছানা। হাত দুটু 

উড়ে গেছে, দু’পায়ের হাটুঅব্দি ব্যান্ডেজ। 


একবারও ভাবলে না, তিনি তোমার কেমন বাবা! 

তার সম্পত্তির ভাগ পাবে? তার কালো কাচের পাজারুটা 

তোমাকে দেবে? দেবে মখমল বিছানো বেডরোমে ঘুমানোর অনুমতি?

তার সম্মান রাখবে তুমি! তার ছেলে বিদেশে পড়ে, 

নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে; সে তো ঝাপিয়ে পড়ে না!


তোমার হোষ কবে হবে রঞ্জু! তুমি ছিলে তাদের 

স্বার্থের হাতিয়ার, কাটা তোলার কাটা। 

তোমার মা হাসপাতালে গরাগরি দিয়ে কাদে, বাপ কাদে বাড়ান্দায়। 

সেই নেতারা, তোমার পাতানো বাবারা, একবারও তো 

দেখতে এলো না! বলি রঞ্জু, তোমাদের হুশ কবে হবে!

........................................................................................

অনন্য উপহার


মেয়েটা হাতের একটা চুড়ি খুলে বললো- “এই নাও, রাখো।

যেদিন তোমার ঘরে বউ হয়ে যাবো, বাসর রাতে পরিয়ে দিও”।

ছেলেটা একটা চাবির রিং মেয়েটাকে দিয়ে বললো-

“যতেœ রেখো। আমাদের সংসারের সব চাবি

এটাতে গেঁথে আঁচলে ঝুলাবে”।


একদিন ছেলেটার আবদার- “তোমার একটা ওড়না

আমাকে দেবে? মধ্যরাতে বালিশে জড়াবো, আর

তোমার বুকে নাক গুজে রেখেছি ভেবে চুমো খাবো”।

আরেকদিন মেয়েটা নাছড়বান্দা-

“হলুদ পাঞ্জাবিটা তো আর পরো না। আমাকে না হয় 

দিয়ে দাও, বুকের উপর রেখে ঘুমাবো”।


তাদের পাশাপাশি দাড়িয়ে তোলা অন্তরঙ্গ ছবির একটি

ছেলেটা তার মানিব্যাগে রেখে দিলো। ভাবটা এমন,

যেন উপার্জিত সকল টাকা বউয়ের কাছেই জমা রাখছে।

এদিকে মেয়েটা এমনই অসংখ্য ছবি মোঠোফোনে

গোপন ফোল্ডারে সেভ করে নাম রাখলো “সুখি সংসার”।


কালের আবর্তে কি হলো কে জানে (হয়তো পরিজনেরা মানবে না,

নয় তো অন্য কিছু) মেয়েটা একটা আংটি

রেপিং পেপারে মুড়িয়ে ছেলেটার হাতে দিয়ে বললো-

“যে তোমার বউ হবে, তাকে দিও। বলো আমি দিয়েছি।

আর আমাকে কোনদিন ভুলে যেও না”।

ছেলেটা সে আংটির বক্স হাতে নিয়ে

ছুঁড়ে মারলো নর্দমায়। তারপর দুজন দুজনকে

জরিয়ে ধরে বসে রইলো কতক্ষন। দুজনেরই চোখ বেয়ে

নামলো নিরব কান্না।


তারপর? তারপর যা হবার তাই হলো। প্রকৃত ভালোবাসা 

কোনদিন মরে যায় না। মেয়েটার বিয়ে

হয়ে গেলো অচেনা জনের সাথে।

প্রেমিকের দেওয়া চাবির রিংটাতেই সব চাবি আঁচলে বেধে 

শুরু করলো সংসার। আর ছেলেটা অন্য মেয়েকে বিয়ে করে

হাতে পরিয়ে দিলো প্রেমিকার চুড়িটা।

........................................................................................

ভিনদেশে বিপর্যস্ত


মা আমাকে তার মাতৃসুলভ আচরণে

স্নেহের হাতে তুলে খাইয়ে দিতে চাইতো, আমি দেইনি সম্মতি কখনো

তার বুড়ো আঙুলের নখটা কেমন মড়া ঝিনুকের

ফ্যাকসা খোলসের মতো ছিল বলে।

শৈশবে স্কুলে পৌঁছবার রাজপথে

যেদিন প্রথম দেখেছিলাম শিয়ালের থেতলানো দেহ

টানা তিনরাত ঘুমোতে পারিনি দুঃস্বপ্ন দেখার ভয়ে, পারিনি করতে 

আহার স্বাভাবিক। চোখের সামনে শুধু উঠতো ভেসে 

বিচ্ছিন্ন মস্তক একটা মরা শিয়াল যার উসকোখুসকো চামড়ায়

জমে আছে রক্তের স্তূপ আর তকতকে নীল মাছি।


খুব বেশি খুতখুতে

স্বভাব ছিল আমার। বাবা একবার আমার গামছা দিয়ে 

মুছে ছিলেন তার শস্যক্ষেত থেকে ফিরে আসা ঘর্মাক্ত পিঠ,

সেই অপরাধে তার চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার

করে দিয়েছিলাম মূর্খের অপবাদ দিয়ে। এক বিছানায় ঘুমোতে গিয়ে 

আমার যে ছোটভাইটা গায়ের উপর তুলে দিতো পা

আমি এক চড়ে তার কান থেকে রক্ত ঝরিয়ে বুঝিয়েছিলাম 

ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে যাওয়ার খেসারত। 


এখন আমার ঘুম আসে না, ঘুম আসে না রাতে

ছাড়পোকা আর মশাদের উৎপাতে। উৎকট গন্ধে

বন্ধ দম, শৌচাগারের পাশে বিছানায় নেই গা ঢাকা দেবার মতো 

টুকরো কাপড়। শীতে জুবুথুবু হয়ে যখন কুকড়ে যাই

তোকে বড়ো মনে পড়ে, তোকে বড়ো মনে পড়ে ভাইরে। ঘুমঘোরে একটি পা

গায়ের উপরে তুলে দিবি না আমায়

একটু আরাম উত্তাপ? বল, তুই করবি না

ক্ষমা আমায়...?


ওরা যখন আমাকে নিয়ে এসেছিল ভিনদেশে

বলেছিল কাজ দেবে পাঁচতারা হোটেলে, নিদেনপক্ষে মুদির দোকান তো

জুটবেই কপালে। সূর্য ওঠার আগে

শাবল ক্ষন্তা আঁকশি হাতে লেগে যাই কাজে, নগরের নর্দমা

শোধন এখন আমার কাজ। 

যে হাতে ধরিনি গরুর দড়ি গোবর চনার গন্ধ লাগবে বলে

সে হাত ধরে পঁচা ইদুরের লেজ, পলিথিনে মোড়া 

মাছি ভনভন করা মাছের পুরনো আঁশ। পরিত্যক্ত আবর্জনা 

তুলে নিই পিঠের ঝুলিতে। বড়ো অসহায়, বড়ো অসহায় লাগে মা,

মনে হয় মরে যাই; না গেলে কাজে নিতান্ত বুভূক্ষু

কাটে দিন, পানিটাও এইদেশে কিনে খেতে হয়, টাকা ছাড়া জোটে না

কান চুলকানোর কাঠিটি পর্যন্ত। 


একবার, শুধু একবার, মা তোমার গোবর গুলে গৈঠা বানানো হাতে

একমুঠো ভাত খাইয়ে দিয়ে যাও। 

বাবা, ও বাবা, আমার গায়ের সবচেয়ে সুন্দর যে জামাটি

তাতে মোছো তোমার ভাত খেয়ে না ধোয়া হাত। তোমার সফেদ দাড়ির ভাজে

তরকারির যে ঝোল লেগে থাকে

সেই ময়লাটি জিহ্বায় চেটে তুলে নিতে বড়ো ইচ্ছা জাগে আমার। 

........................................................................................

প্রতীক্ষিতের ফরিয়াদ


করিডোরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, এমন করে তুমি আসবে 

ভাবিনি কখনো। তোমার কথা 

খুব মনে পড়তো। পড়বে না...!

আমার পেটে যে তোমার সন্তান।

আমি তার মাঝে অনুভবে 

তোমার স্পর্শ পাই। অনাগত, তবে অচিরেই

পৃথিবীর মুখ দেখবে। 


তোমার খুব জানতে শখ ছিল, উদরগহীনে

শিশু কেমনে নড়েচড়ে ওঠে। সে কি হাত পা ছোড়ে

এদিক ওদিক, সে কি মাকে মা ডাকতে পারে, সে কি তোমাকে

বাবা বাবা ডাকে, কী কৌতূহল তোমার। 

পেটের মাঝে কান পেতে রইলে আধাঘন্টা, কোন ফল

পেলে না। না মা ডাক, না বাবা ডাক, না কোন

কান্না-হাসি। 

আমি শুধু হাসলাম তোমার পাগলামি দেখে

আর কুকড়ে গেলাম সুরসুরি পেয়ে। নাভীর উপর

চুলের ঘষা, সুরসুরি লাগবে না তো কী...!

তুমি কোনদিন

বাবা ডাক শুনতে পাবে না; কী দুর্ভাগা তুমি।

এমন করে তুমি আসবে ভাবিনি কখনো। সীমান্ত প্রহরীদের

ছুটি মেলে না সহজে, তাই

আমার মতো স্ত্রী-গণ

চিরপ্রতীক্ষার পাত্র। ছুটি নেই বলে

হানিমুনটাও করা হয়নি। তুমি বলতে পেনশন পেয়ে

তবে যাবে হানিমুনে, সাথে থাকবে নাতি নাতকর।


কখনো সখনো ফোনে কথা হলে বলতে তুমি

ফোনটা যেন একবার 

ঠেকাই পেটে, অগ্রীম বাবা ডাক

শোনা চাই তোমার; কী পাগলটাই না ছিলে তুমি।


করিডোরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, এমন করে 

তুমি আসবে ভাবিনি কখনো।

গাড়ি এসে 

থেমেছিল রাস্তার শেষ সীমানায়, একটা কফিন 

নেমে এল ক’জনের কাধে 

ভর করে। বাংলাদেশের পতাকা মোড়ানো তোমার লাশ। 

গুলিটা তোমার কোথায় লেগেছিল-

ফুসফুসে, কলিজায়, নাকি হৃদপি-ে?

নিশ্বাস যখন

বন্ধ হয়ে এল, অন্ধ হয়ে এল পৃথিবীর আলো

আমার কথা তোমার কি মনে পড়ছিল,

কিংবা আমার উদরপুষ্ট শিশুটির কথা? জলে ডোবা মানুষের 

মুহূর্তে বিস্মৃতি স্মরণের মতো।


তোমার অনাগত সন্তান বাবা ডাকবে কাকে? কে শুনবে 

তার বাবা বাবা ডাক? পিতৃছায়াহীন

বেঁচে থাকা কী যে বেদনার। 

........................................................................................

উৎসব

        

বাবা যাদের সরকারি অফিসে ছা-পোষা কেরানী

তাদের আবার উৎসব কী! তিন বেলা খেতে পাই, এই তো বেশি।

আমরা হিন্দু। অফিসের বড়কর্তা

বাবাকে দিয়েছিলেন নিমন্ত্রণ- ‘বেড়াতে এসো সপরিবারে,

ঈদে খুব আনন্দ হয়।’


প্রভাতে দেখলাম মুসলিম লোকদের পরনে

পাঞ্জাবি-টুপি, হাতে জায়নামাজ, দল বেঁধে

যাচ্ছে ঈদগাহে। নামাজ শেষে পশুর গলায় চালাবে ছুরি।

বেলা বাড়তেই বাবা ডেকে বললেন- ‘চল বেড়িয়ে আসি 

স্যারের বাসায়। সম্মানিত লোক, সাক্ষাৎমাত্র

পা ছুঁয়ে করবি সালাম।’

বাবার কথা রাখলাম। স্যার আমাকে

অবাক করে হাতে ধরিয়ে দিলেন

দুটি পাঁচশো টাকার নোট, ঈদের সালামী।

এবং পরম মমতায় বসালেন পাশের সোফায়; খেতে দিলেন

দুধেল সেমাই, ভাজা মিষ্টি পাঁপড়। বাবার সঙ্গে স্যার 

কথা বলছিলেন এমন হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিমায়, দেখলে কে বুঝবে 

অফিসের বড়কর্তা আর সামান্য কেরানীতে চলছে আলাপ! 


স্যারের একটা ছেলে, আমারই মতন বয়স। দুজনে

অনেকটা সময় খেললাম ক্রিকেট, দেখলাম 

কুরবানীর মাংসের কাটাকুটি।

যখন বিদায় নিয়ে চলে আসবো, আমাকে দিলো

খাসির মাংসভরা একটা থলি। প্রায় দু’কেজি ওজন।

চোখ জলে ঝাপসা হয়ে এলো, আর নম্রতায়

নতমাথায় ভাবলাম- ‘ধর্ম যাই হোক, কোন উৎসবই

কারও একার নয়, আর ঈদও একটা উৎসব।’

........................................................................................

নির্যাতনের মতো ¯স্নেহ


মায়ের কিছু আচরণ মারাত্মক

পীড়া দিতো আমায়। আমি এর নাম রেখেছিলাম 

নির্যাতনের মতো ¯স্নেহ।


ধরা যাক, বন্ধুবান্ধবে আড্ডা। ফোনে যন্ত্রণার ঝড় তুলে

মা জানতে চায়- শরীরটা ভালো কি না? খেয়েছি কি না সসময়ে?

বাড়িতে নিজ হাতে খাওয়াতো; আমার মোটেই

লাগতো না ভালো। অনার্স পড়–য়া ছেলে 

মায়ের হাতে ভাত খাচ্ছে- কী লজ্জা!

গোসলখানার দরজায় ঠক-ঠক। তোয়ালেতে সাবান মেখে

উপস্থিত মা। পিঠে কালি-ময়লার চর, ঘষেমেজে

তুলবে যখন, আমি সুরসুরি পেয়ে দলাই-মলাই।

হঠাৎ যদি অসুখ বাঁধতো, যেমন সামান্য জ¦র, 

মা রাতজেগে ছেলের মাথায় ঢালতেন জল। ভেজা কাপড়ে 

জুড়াতেন কপালের উত্তাপ। তার চোখভরা অশ্রু দেখে 

রাগে তো আমার দাঁত কটমট।


কোথাও যাবার বেলায় মা উঠোন পেরিয়ে 

রাস্তা অব্দি আসতো। ক্ষণে ক্ষণে বলতো- ‘সাবধানে থাকিস’।

আঁচলের গিঁট খুলে হাতে দিতো তুলে

খুচরো পয়সা কিছু- পথে পড়বে প্রয়োজন।

রিক্সাতে উঠে মায়ের উদ্বেগী মুখটায় 

তাকাতেই খুব কষ্টে জমতো কান্না

চোখের কোণায়। মাঝে মাঝে নিঃশব্দে চলে আসতাম।


তার এক বদভ্যাস, যাত্রাকালে ¯স্রোষ্টার নামে 

আমার কপালে দেবে অন্তত তিনটি ফুঁ...

এতে নাকি বিপদের ছায়া কাটে, কুগ্রহের কালগ্রাস থেকে

বাঁচবো আমি। ওসবে বিন্দুমাত্র ছিলো না বিশ্বাস, তবু

একদিন বেজেউঠা ফোন রিসিভ করতেই

শশ্বব্যস্ত মায়ের গলা- ‘রিক্সাটা 

থামা বাবা, তোর মাথায় তো ফুঁ দেওয়া হয়নি’।

আবদার রাখতে প্রথম বাসটা মিস, দ্বিতীয়টায়

চড়ে বসলাম। বাস ছুটছিল

বাতাস কাটা বেগে; আচমকা কড়া ব্রেকের ঝাঁকুনিতে 

যাত্রিরা থতোমতো। বাইরে ভীর, শহরগামী প্রথম গাড়িটা 

পড়ে আছে ব্রিজের নিচে, আর প্রায় সব কয়

যাত্রীই নিহত। আহা... এতোক্ষণে হয়ে যেতাম ওপারের বাসিন্দা।


মায়ের মৃত্যুর পর আজই প্রথম

বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছি। এতোবার পিছু তাকালাম, মায়ের মুখটা 

দেখতে পেলাম না; বড়ো উদ্বিগ্ন চিন্তাশঙ্কুল সেই মুখ

কোনদিন দেখা হবে না এই পৃথিবীতে। 

মা... মা গো... তোমার সন্তানের ওপর থেকে 

সকল বিপদের ছায়া, কুচক্রির কুনজর কি কেটে গেছে...!

একটি বার কেনো আসো না তবে

দিতে মঙ্গল ফুঁ...! কেন পিছু ডেকে বলো না-

‘এই নে খুচরো কয়টা টাকা, পথে কিছু কিনে খাস’।

........................................................................................

টাইমফুল


বারান্দার ঝুলন্ত টবে ফুটেছে টাইমফুল। ঘাসের ডগায়

গোলাপ-আকার মেরুন ফুলগুলো

সকাল দশটায় ফোটে, চুপিসারে চুপসে দুপুরের প্রথম ভাগেই।

এই ফুল আমাদের উঠোনে, ভিটের পাশে

যেখানে টিনের চালের পানি ঝরে, সেখানে ফুটতো অনেক।


বাবা, তখন সাইকেল হাতে দাঁড়াতে আঙিনায়। ক্রিং ক্রিং

বেল বাজিয়ে বলতে- ‘দেরি হয়ে গেলো, কই-রে... আয় তাড়াতাড়ি’।

আমি বইপত্র গোছাতে ব্যস্ত, আর মা আমার চুলে

বাঁধছেন ঝুঁটি চিরুনি চালিয়ে- তারপর দুটো ক্লিপ।

বাবা তুমি প্রাইমারি মাস্টার, আমি তোমার স্কুলে

ছাত্রী চতুর্থ শ্রেণির। উঠোনের কোণ থেকে দুটো ফুল ছিঁড়ে

কানে গুঁজে ছুটলাম, সাইকেলে উঠলাম।

তখন মায়ের গলা- ‘গ্লাসভরা দুধ, খেয়ে তো গেলি না’। আমাদের

ছাইরঙা গাভীটা দিতো দুধ এক হাঁড়ি, আর তার বাছুরকে

রাখতো পারিপাটি

জিহ্বায় চেটে। আহা কী মাতৃত্ব! মায়েদের কতো মায়া!


যেদিন আমার বিয়ে ঠিক, সবাই খুশি, বিদেশে

চাকুরে ছেলে, অঢেল টাকা।

মা, তুমি চুপচাপ ছিলে কেনো বলো তো...? মেয়ে মানুষের জাত,

তাই বুঝি যথার্থ বুঝেছিলে মেয়েদের মনস্তত্ব।

টাইমফুল সময় ধরে ফোটে, সময় ধরেই

ঝরে । আমার যৌবন, মাতৃত্ব, সংসার! সময় গেলে তো আর

হবে না সাধন।


তোমাদের মেয়ের জামাই 

বিয়ের প্রথম মাসে গেলো ভিনদেশে। তিনটি বছর পার, তবু

দেশে ফিরবার নাম নেই, সে দেশের গ্রীনকার্ড পেয়ে

তবেই ফিরবে, জানি না লাগবে কতো দিন।

তুমি তো জানো না মা, জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে

দূরের আকাশ দেখি। দেখি উড়ে যাওয়া মেঘ, পাখি আর বিমান।

বড়ো একা একা লাগে, মানুষের সান্নিধ্যের অভাব

কী যে যন্ত্রণার, কী করে বুঝাই!

আমি যেন পৃথিবীর বিলুপ্তপ্রায় সেই প্রাণি, বেঁচে আছি

একটি মাত্র- একাকি।

খুব জাগে সাধ, ফিরে যাই শৈশবে। বাবার সাইকেলে

ক্রিংক্রিং। তোমার ¯স্নেহে ঝুটিবাঁধা চুল, কানেগুঁজা টাইমফুল।


সোনার চুড়ি, হিড়েকুচি নেকলেস, বিদেশি প্রসাধন

যেন আমার হাতের শিকল- যেন আমাকে লোহার খাঁচায়

ঝাপটে ধরে, অজগর হয়ে খেতে চায় গিলে।

এমন জীবন আমি চাইনি বাবা, এমন জীবন আমি 

চাইনি তো মা, এমন জীবন আমি চাই না ঈশ্বর।

........................................................................................

হুইল চেয়ার


‘হুইল চেয়ারটা না কিনলে কী হতো, মা আর

ক’দিনই বা বাঁচবে...!’

মুখ বাঁকিয়ে বকবকাচ্ছে মিলি। স্বামীটার নেই

একটুও বিবেচনাবোধ, টাকাগুলো জলে ভাসালো ।

স্ত্রীর চিৎকার শুনে শুনে যন্ত্রণাদগ্ধ মিলন

ধরালো সিগারেট। ধুয়ায় ঘরটা ধুয়াটে। ইচ্ছে হচ্ছিল

সারা বাড়ি আগুনে জ্বালিয়ে দিতে।


পাশের ঘরেই বৃদ্ধা, শুয়ে শুয়ে শুনছেন। চোখের কোণের

জল গড়িয়ে পড়লো বালিশে।

বউ-ছেলেতে ঝগড়া, কারণ

হুইল চেয়ারটা। মনে মনে বললেন-

‘আজরাইল কেন আসে না...! পরগাছা হয়ে

বাঁচার চেয়ে মৃত্যু ভালো।’


চার বছরের শিশু চেঁচামেচি শুনে খেলনাগুলো গুটিয়ে

ভয়ে কাঁপে। মায়ের দিকে তাকায়, তাকায় বাবার মুখে ।

কাজের মেয়েটা বলে- ‘মানুষকে তার কর্মফল

পৃথিবীতেই পেতে হয় গো খালা, আপনার পুত্রবধু

করবে এমন আচরণ যেমনটা করছেন শাশুড়ির সাথে।’

মিলি বিদ্রুপের সুরে শুনায়- ‘পুটলা-পুটলি বেঁধে

দেবো বাপের বাড়ি পাঠিয়ে। বুঝবে তখন।’


বৃদ্ধাকে বেশিদিন সইতে হয়নি, মৃত্যু এসে নিয়ে গেছে।

হুইল চেয়ারটা কিছুকাল বারান্দার কোণায়

যত্নে ছিল তোলা। দেখলাম, তাদের একমাত্র ছেলেকে

কাজের মেয়েটা সেই চেয়ারে চড়িয়ে

বারান্দা ও ঘরে আনা-নেওয়া করে।

কী এক অজ্ঞাত রোগে ছেলেটা এখন পঙ্গু। ডাক্তার জানিয়েছেন

কোনদিন পারবে না নিজ পায়ে দাঁড়াতে।

ওদের বারান্দার গ্রিলে চোখ রেখে বলি- ‘চাকাওয়ালা চেয়ার

কেনার টাকাগুলো বৃথা গেলেই ভালো হতো।’

........................................................................................

অপার্থিব


ফলে ফরমালিন, মাছের কানকো পঁচা, চালে কাঙ্কর।

দোকানিকে বৃথা বকে-ঝকে মুখে তুলছো ফেনা, বুঝোই না

তোমার কৃতকর্মই তোমায় ঠকে যেতে বাধ্য করেছে।

সুদখোর, মিথ্যাবাদী, ফন্দিবাজ, আমানতের খিয়ানতকারীদের 

বিধাতা করেন বঞ্চিত সমস্ত নিয়ামত থেকে।


ব্যাংকে অসৎ টাকা ক্রমানুপাতিক বাড়ছে, যেন বন্য শুকর 

মাস মাস সন্তান প্রসবরত। অফিসের ফাইল আটকিয়ে 

খোঁজ বখশিশ, শিকার সন্ধানী ধূর্ত শিয়াল; তুমি ঘুষখোর নও...!

বন্ধুরা টাকা ধার নিলে মহামান্য আবু বকর 

উঁচু গলায় বাগারম্বর তো নয়, করতেন অপরাধির মতন

বিন¤্র আচরণ। অতিরিক্ত আদায় দূরে থাক, বৃষ্টির রাতেও 

ঋণগ্রস্থ বন্ধুর বারান্দায় নিতেন না আশ্রয়, যদি সুদ বিবেচ্য হয়।

প্রতিবেশি যথাসময় ঋণ শুধতে না পারায় তুমি 

পথে পেয়ে করো অপদস্ত।

তিরিক্ষি মেজাজ জুড়াতে সে করে আপ্যায়ন । চায়ের কাপে

বিস্কুট চুবিয়ে পা নাচাও আয়েশী ভঙ্গিমায়; লজ্জা করে না...!


খলিফা ওমর কাচারিতে ব্যস্ত। এক রাতে এলো অতিথি এক।

নিভিয়ে দোয়াত আঁধারে বসেই ওমর

কথা বলছিলেন আগন্তুুকের সাথে। ব্যক্তিগত ব্যাপারে 

সরকারি তেল ক্ষয় সমীচীন নয়, কী সাংঘাতিক সৎ মানসিকতা...!

তুমি স্কুলগামী সন্তানকে ঘরে ফেরাতে, শ্বাশুড়ীকে হাসপাতাল নিতে

পাঠিয়ে দাও অফিসের চৌচাকা, যার কাজ

শুধু তোমাকে বহন। অফিসের টেলিফোনে 

করো পারিবারিক বাৎচিত, বুঝোই না এ যে অন্যায়...!


তোমার সন্তান নষ্টের দখলে যাবে। অতি আধুনিক কন্যা 

অশালীন পোশাকে বন্ধুর হাত ধরে পালাবে, ফিরবে না কোনদিন।

ছেলেটা মদের বোতল হাতে আসবে তেড়ে বুনো মহিষের মতো

তোমাকেই গুতিয়ে মারতে। সুন্দরী বধূ পরকিয়ায় মেতে নাইট ক্লাবে 

কাটিয়ে আসবে রাত। 

তোমার শ্রমে ঘামে গড়া অট্টালিকায় ধরবে ফাটল। যখন মৃত্যুদূত

দাঁড়াবে দুয়ারে, এই ধন, এইসব আত্মীয়-স্বজন 

মুহুর্তে ফেরাবে মুখ। মৃত মানুষের শূন্য মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে 

কেউ দেয় না গুঁজে পার্থিব সম্পদ।

........................................................................................

নির্বাচনি ফলাফল


দাদা বাঘ মার্কায় দাঁড়িয়ে ছিলেন।

গ্রামের নির্বাচন, মেম্বারী পদ। পাশ তিনি

করতে পারেননি; তবু নাম রটে গেলো বাঘ।

প্রতাপ বুঝাতে নিজের জমিতে করেছিলেন

একটি বাজার স্থাপন, সে বাজার আজও

বাঘের বাজার নামে খ্যাত। 


খাদ্যের চাহিদা মিটে গেলে মানুষ

সুনামের কাঙাল হয়। নাম-সুনাম

জুটে গেলে চায় ক্ষমতা।

আমার বন্ধুর মামা, জীবিকার

অভাব ছিল না, তাই চেয়েছিলেন সুনাম।

পরিচিতি অর্জনের সহজ উপায়

নির্বাচনে দাঁড়ানো।

পরাজয় নিশ্চিত, জনগন চায় না জেনেও

টাকার জোরে নাম লিখালেন

চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর তালিকায়। লটারীক্রমে

মার্কা জুটলো গাভী, মানে গাই।


যখন ফেল মারলেন, গ্রামসুদ্ধলোক বলতে লাগলো-

‘গাই ফুতছে...’।  নির্বাচনে পরাজিত হওয়া তো

শুয়ে পরারই সমতুল্য।

সেই থেকে তাকে দেখলেই

লোকে বলাবলি করে- ‘গাই আইতাছে, গাই।’

সুনাম ছড়াতে গিয়ে লোকটার রটে গেল কতো বদনাম...!

........................................................................................

পরিণতি


মা। যখন সন্তানের মুখে স্তন গুজার কথা, দোলনায়

দোল তুলে ঘুমপাড়ানিয়া গান শোনাবার কথা

দাসির হাতে দুধের বোতল দিয়ে মজেছো টিভি নাটকে, সিনেমায়।

বাবা। যখন সন্তান নিয়ে দৌড়-ঝাপ, লুকোচুরি, ফুটবল

এটা ওটা খেলাচ্ছলে কোলে তুলে চুমু বিলাবার কথা

পোষা কুকুরের শিকল ধরে ঘুরছো পার্কে-ময়দানে, ভালোবেসে

পিঠের লোমে বুলাচ্ছো হাত।

শিশুটা কাঁদছে একাকিত্বের যন্ত্রণায়, জানালার গ্রীলে

ঠুকছে কপাল। অথচ তোমরা বন্ধুবান্ধব আর

প্রিয় খুনসুটিতে কাটাচ্ছো দিন-রাত, ছেলেকে রেখে অবহেলায়।


তোমাদের সন্তান ঘরের দেয়ালে একটি দুটি অক্ষর

নচেৎ ফুল-পাতা-চিত্র এঁকে দাড়িয়েছে কুড়াতে প্রশংসা।

ভ্রুয়ের পাশে যন্ত্রণা এনে ভেবেছো- ধুর ছাই...

কেন এই জঞ্জাল পোষা! ঢের ভালো

নিঃসন্তান জীবনটা উপভোগ। অথবা তাকে শিশু-সেবাকেন্দ্রে

দেবে নির্বাসন আগামী মাসেই।


হুম... তোমাদেরকেই বলছি... শোন হে জননী এবং জনক

তোমাদের দুর্দিনে, ধরো... প্রবীণ বয়সে

হাতের লাঠি অথবা চশমা যদি হাত ফসকে নাক উপচে

পড়ে যায়, আসবে না কেউ ছুটে পুনরায় তুলে দিতে।

ছেলেটা পাশের ঘরে বউ নিয়ে মাতবে

হাসি-তামাসায়! তোমরা একা অন্ধকারে শক্তিহীন

সন্ধ্যাবাতি জ্বালাবার। পিঞ্জিরায় কাঠবিড়ালী, তাকে সময় সময়

খাবার দিতে ভুলবে না পুত্রবধু।

অথচ শ্বশুড়-শ্বাশুড়ীকে অষুধ সেবনে

প্রায়ই হবে ভুল। আর যদি বড়ো বেশি বোঝা হয়ে ওঠো

তোমাদের আশ্রয় হবে বৃদ্ধাশ্রম, শুধু বৃদ্ধাশ্রম।

........................................................................................

চাকরী সমাচার

 

চাকরী চাই। পিয়ন হবার জন্য পনেরো লাখ।

ঘুষে হোক, তবু সরকারি চাকরী। একবার জুটে গেলে

ফাঁকিতে ঝাপিতে জীবন পার।


আমি জানি, সরকারি চাকরী মানে একজন স্ত্রীর একটাই স্বামী।

মাস ফুরালে বেতন, সঙ্গম শেষে যেমন

আদর আদর আর আদর।

আমি জানি, বেসরকারি চাকরী মানে একজন বেশ্যার

অনেকগুলো নাগর; রাতভর বলাৎকারের পর গায়ে মুখে

ছুড়ে মারবে কয়টি টাকার নোট।

আমি জানি, আত্মকর্মসংস্থান মানে ধর্ণাঢ্য সমাজপতির

আদুরে কন্যা। যাকে বাটে ফেলতে লোকেরা তেল মেখে

দাড়করিয়ে রেখেছে গোপনাঙ্গ; নিস্ফল আশায়।


“কী করো তুমি? সফ্টওয়ার বিজনেস! ওহ... তুমি বুঝি

চাকরী পাওনি?”

“কী পেশা তোমার? ফ্রিলেন্স ওয়ার্ক! একটা চাকরী

জুটিয়ে নিলে ভালো হতো।”

“তুমি নাকি সিনেমা বানাও? তোমার নাকি

গরু মোটা-তাজাকরণ প্রজেক্ট? হাস-মুরগির খামার?

এসব ফেলে চাকরী খোঁজো বেটা। না হলে কেউ

মেয়ে দেবে না।” -এই আমাদের সমাজ।


বনরাজ সিংহের মুক্তজীবন নয়, এ জাতি পনেরো লাখের বিনিময়ে

সোনার শিকল কিনে পোষা কুকুরের মতো গলাতে ঝুলাবে

আর অনুগ্রহের আশায় মালিকের মুখে তাকাবে।

ধনী বাপের আদুরে কন্যা না হয়ে

পুরুষের একমাত্র বউ হওয়াতেই যেন সব আগ্রহ।

হায় রে হুজুগে মাতাল জাতি, হায় রে আরামপ্রিয় ফাঁকিবাজ।

........................................................................................

শেলটার


ভ্রুম ভ্রুরুম ভ্রুরুরুরুম... একটা মোটর বাইক 

চষে বেড়াচ্ছে কলেজ ক্যাম্পাসের এপাশ ওপাশ। 

ক্লাশ ফাকি মেরে কাঠাল তলায় আড্ডাবাজিতে মাতা ছেলেগুলো, 

একলা আসা মেয়ে দেখলেই সিগারেট-পোরা ঠোটে 

শিশ বাজানো ছেলেগুলো উত্তেজনার জোয়ারে ভাসছে। 

ক্ষনেক্ষনে দুজন তিনজন চড়ে বসে বাইকটায়, আকাশ বাতাস 

কেপে ওঠে বিভৎস শব্দে। আমি ভাবি মালিক কে! সবাই দেখি 

মালিকশোলভ গাম্ভীর্যে চালায়!


একজনকে ডেকে জানতে চাই- “মেটর সাইকেল পেলে কোথায়?”

ছেলেটা শ্রদ্ধায় ঝড়কবলিতো সুপারি গাছের মতো 

মাথা ঝুকিয়ে বললো- “জলিল দারোগা দিয়েছে স্যার... 

আপন ভাইয়ের সমান স্নেহ করে আমাদের।”

দারোগা সাহেবকে পথে পেলে 

তিনি জানালেন- “বর্ডারক্রস চোরাই মাল, থানায় পরে

নষ্ঠ হচ্ছিলো। ছেলেদের দিয়ে দিলাম, চড়ে ফিরে শখ মেটাক।”

আমি বলি- “পড়াশোনা তো গোল্লায়, ছেলেগুলো 

বিপথে যাবে, সারাক্ষন শুধু ভ্রুম ভ্রুরুম ভ্রুরুরুরুম...”

“কি যে বলেন মাস্টার! এই বয়সে 

জীবনটা উপভোগ না করলে আর কখন! 

ওরা সরকারের ডান হাত, আগামী দিনের নেতা। যা করে 

তাতেই দেশের মঙ্গল।”


বুঝলাম কথা বাড়ানো বৃথা। কদিন যেতেই শুনি 

বাইক চালকেরা দোকানে দোকানে চাঁদা তুলে, চাঁদা তুলে 

চলন্ত গাড়ি থেকে রাস্তায়। 

উত্তলিত টাকার একভাগ নিজেদের একভাগ দারোগার 

একভাগ যায় উপরমহলে।

রাতে দারোগা এসে তাদের সঙ্গে বসে চা-বিস্কুটে, ফিসফাস আলাপনে, 

অট্টহাসিতে জমান আড্ডা।

ছেলেগুলো মদের বোতল হাতে রাস্তা মাতায়, কেউ কিছু বলে না, 

মেয়েদের ওড়না ধরে টানে, কেউ প্রতিবাদে দাড়ায় না। 

থানাটি তাদের বৈঠকঘর, দারোগা তাদের 

তাঁসের সঙ্গী, তারাই আইনপ্রনেতা।


তারপর এলো নির্বাচন। ভোট চাওয়া চাওয়ি, মিছিল মিটিং। 

সরকার বদল। নতুন দল এলো ক্ষমতায়। ভাবলাম 

এইবার থামবে। কিন্তু একি! এবার দুটো মোটরবাইক, দিগুন শব্দ,

তিনগুন হইহুল্লুর, চারগুন চাদাবাজী।

পরিচিত দোকানিরা নালিশ জানায়- “ওরা তো আপনরই ছাত্র স্যার, 

আপনি বললে থামবে। কোমরে পিস্তল গুজে চাঁদা তুলে...”

বিকেলে খেলার মাঠে আমি ওদের ডেকেছিলাম। ছেলেগুলো 

গলে যাওয়া মোমের মতো পায়ের কাছে জড় হয়ে বসলো। আমার সকল 

উপদেশ মেনে নেওয়ার ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়লো।

সন্ধায় এলেন জলিল দারোগা- “জং ধরা পিস্তল মাস্টার, 

গুলি তো বেরোয় না। লকারে রাখলেই কী, 

আর ওদের হাতে থাকলেই কী! তাছাড়া ওদের 

উঠতি বয়স, বাধা দিলে ঘাপলা বাধাবে।”


দারোগার ফ্যাশফ্যাশে হাসি শুনে কেবলই আমার কানে বাজছিলো 

উঠতিবয়সি মেযয়ের আকুতি- “ওড়নাটা ছেড়ে দিন, 

আপনারা আমার মায়ের পেটের ভাই।”

বৃদ্ধ পথচারীর চোখে ভয়- “দিচ্ছি দিচ্ছি সব, পিস্তল 

পকেটে রাখো বাবা, তোমরা আমার ছেলের বয়সি।”

পরিচিত কারও অভিযোগ- “ওরা তো 

আপনারই ছাত্র স্যার, একটু থামান...”

আর বাজছিলো- “ভ্রুম ভ্রুরুম ভ্রুরুরুরুম... ভ্রুম ভ্রুরুম ভ্রুরুরুরুম...”

........................................................................................

দুটানায় দিনযাপন


বাবার ক্যান্সার।  গলায় ব্যান্ডেজ, ব্যান্ডেজে রক্ত। 

এগারোটি থেরাপিতে চুল সাফ। চামড়ায় কালো দাগ। বিদেশে নিয়ে 

ভালো ডাক্তার দেখালে হতো। টাকা কোথায়...


বউকে ডেকে জানতে চাই- “কী করতে পাড়ি?” 

বউ বলে- “যা ভালো মনেহয় করো। ”বাবা যখন যন্ত্রণায় কুকিয়ে উঠে,

চিংড়ি মাছের মতো দলা পাকিয়ে যায়, বড়ো মায়া হয়।

সিদ্ধান্ত নিলাম বাড়িটা বেচে দেবো। কিন্তু, বউ সন্তান নিয়ে 

থাকবো কোথায়! এদিকে বাবার মৃত্যু যন্ত্রণা, ওদিকে একমাত্র ছেলেকে 

অকুল সাগরে ফেলা। 

চিকিৎসার অভাবে বাবা মরলে লোকে বলবে- “কেমন ছেলে! 

বিনাচিকিৎসায় বাবাকে মারলো।” বাড়ি ভিটা বেচে দিলে 

কুৎসা রটবে- “কেমন বাপ! সন্তানের কথা ভাবলো না!”


অসুস্থ বাপ বাড়ি বিক্রির গুঞ্জন শুনে বলেছিলো- “আমি আর কদিন! 

তোরা সুখে থাক বাবা, নাতিটার খেয়াল রাখিস।” 

কার খেয়াল রাখবো, নাতিটার? নাকি অসুস্থ বাবার? ভাবতে ভাবতে 

কাচের গ্লাসে বেলের শরবতে চামচ নাড়ছিলাম। 

হাত পা কাপছে, মুখ ঘামছে। শরবতে তিন ফোটা বিষ 

মিশিয়ে দিয়েছি আমি। তিব্র বিষ, মুখে নিলে মৃত্যু।

মনেপড়লো ছোট বেলায় ম্যালেরিয়া জরে 

সতেরো দিন ছিলাম হাসপাতালে। চিকিৎসার খরচ যোগাতে 

বাবা তার প্রিয় মোটরসাইকেলটি বেচে দিয়েছিলো। 

কই.. একবারও তো বিষমাখা চকলেট খাইয়ে 

মেরে ফেলার কথা ভাবেনি। হাতের চামচ থেমে গেলো। 

বাবার বানানো বাড়ি ভিটা বেচেই বাবাকে বাচাবো। পরক্ষনে 

মনেপরলো ছেলের পড়াশোনা, বউয়ের আবদার, সংসারের নানা খরচ।


বেলের শরবতে বিষ। না... বাবার হাতে কিছুতেই 

বিষের গ্লাস ধরিয়ে দিতে পারবো না। 

বাবা কতো ¯েœহে মানুষ করেছে আমাকে। শহরে রেখে 

শিক্ষিত করেছে, মোটা অঙ্কের ঘুষে চাকরী জুটিয়েছে, তার হাতে 

তুলে দেবো বিষের গ্লাস!

বিষমিশ্রিত শরবত পিরিচে ঢেকে বাবার বিছানার পাশে রেখে 

চলে গেলাম দুর। যেন কিছুই জানি না, জানতেও চাই না। 

যেন বাড়ি থেকে পালাতে পারলেই বাচি, এমনকি পৃথিবী থেকেও...


আমার ছেলেটা গিয়েছিলো বাবাকে ঔষধ খাওয়াতে। 

রুগির পথ্য আপেল কমলা আঙুরের বেশি অংশ 

নাতিকে স¯েœহে খেতে দিতো বাবা, আজ দিলো শরবত ভরা গ্লাস। 

নাতি এক চুমুক মুখে নিয়েই মেঝেতে ঢলে পড়লো। তারপর...

বাবা বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, ছেলে মেঝেতে 

পড়ে আছে নিস্তেজ। কী করবো! হায়... কোন দিকে যাবো আমি...!

........................................................................................


মেয়েলী আবদার


আমার জন্য কেউ পাগল হোক, তা চাই না

শুধু আমাকে বুঝোক। চোখের কোনে বাসি কাজল

লেপটে আছে, এ দৃশ্য যেন তার দৃষ্টিগোচর হয়।

আমি কাদলে তার কাধটা বাড়িয়ে দিক, আর হাসলে


সে তাকাক বিষ্ময় ভরা চোখে। প্রভাতে বিছানা ত্যাগের বেলা

আমার আচল ধরে বলুক- “আরেকটু ঘুমাও, আসেনি

এখনো রোদ জানালার কাঁচে”। গোসল শেষে ভেজা চুলে

আমাকে দেখে কেউ তাকিয়ে থাকুক। অফিসে যাবার আগে


তারাহুরু করে তৈরি চিনি দিতে ভুল করা চায়ে

চুমুক দিয়ে বলুক- “বেশ হয়েছে”। মন খারাপের দিনে

আমাকে নিয়ে ঘুরতে বেরুক। পথের দোকান থেকে

দুটো ফুল কিনে বলুক- “আজ সারাদিন শুধু


তোমারই আরাধনা”। আমি চাই না ওঠতে বসতে 

কেউ বলুক- “ভালোবাসি ভালোবাসি”। শুধু চাই 

যখন রাগ করে চলে যাই, সে আমাকে যেতে না দিক।

ভালোবাসার নিবির সুখে মরে যেতে যেতে মধ্যরাতের বিছানায় 


আদরমাখা শিৎকারে তার নাম ধরে ডাকতে চাই। আর চাই

সাজবো বলে আয়নাতে দাড়াই যখন, পেছন থেকে জরিয়ে

কাধের চুলগুলো সরিয়ে কানেকানে কেউ তো বলুক-

“তোমাকে ছাড়া এই পৃথিবী বড়ো একলা লাগে”।

........................................................................................

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.