তিতলির মনখারাপ
জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় ।।
মন ভালো নেই তিতলির। ছোট্ট প্রজাপতির মতোই মিষ্টি একটি মেয়ে তিতলি। বাবা-মা দুজনেই অফিসের কাজে ব্যস্ত সারাদিন। লিপি আন্টি তার দেখাশোনা করে কিন্তু সে তিতলির মনের কথা বুঝতেই পারে না,তার মনের ভেতর থেকে অনেক প্রশ্ন উঠে আসে।
লিপি আন্টির কাছেই তার উত্তর জানতে চায় আর সে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে বা আমতা-আমতা করে কিছু বলতে চায় যা তার উত্তর নয়।তার করুণমুখ দেখে এখন আর তিতলি তাকে কোনো প্রশ্ন করে না।
মাকে জিজ্ঞাসা করলে বিরক্ত হন। বাবা খুব আগ্রহ দিয়ে শোনেন কিন্তু তিনি যেন কোন দূরজগতের মানুষ।তিন -চারবার বললেও মনে হয় শুনতেই পাচ্ছেন না, কীসব চিন্তা যেন তার মাথায়। তাই এখন প্রশ্নগুলো মনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে কোথায় যেন হারিয়ে যায় আর মনে পড়ে না। গত দশদিন তিতলি বেশ আনন্দের একটা জগতে ছিল, তার জীবনের সব দুঃখ কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল।
তাঁদের কলকাতার ফ্ল্যাটে এসেছিল বিল্টুদাদা, ওর মাসির ছেলে।বিষ্ণুপুরে থাকে সেখানের স্কুলেই পড়ে, পড়াশোনায় খুব ভালো,সবেতেই ভালো।বাবা -মাকে অনেকবার বলতে শুনেছে তার মতো ছেলে নাকি হয় না, একেবারে হীরের টুকরো।
মফসসলের স্কুলে পড়ে যা রেজাল্ট করে তার তুলনা হয় না।গতবার মাধ্যমিক পরীক্ষায় রাজ্যে দ্বিতীয় স্থানে ছিল।উচ্চ মাধ্যমিকেও খুব ভালো রেজাল্ট করবে।এইসব কথা বলার পর মা-বাবা তার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন হয়ে যান আর বলেন,মেয়েটা বোধহয় আমাদের মুখ রাখতে পারবে না।
বিল্টুদা যে কতটা ভালো সেটা এই কদিনেই সে বুঝে গেছে। বড়দিনের ছুটিতে মেসোমশাই কি একটা কাজে কলকাতায় এসেছিলেন। বিল্টুদাকে কয়েকদিনের জন্য ওদের বাড়িতে রেখে ফিরে যান। আবার কাল এসে কলকাতার কাজ সেরে আজ বিল্টুদাকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন।
এই কটাদিন সে একটা স্বপ্নরাজ্যে ছিল। তার নামি স্কুলের মিস-রা যা পড়ান তা সে ঠিকমতো বুঝতে পারে না। এমন কী তার বাড়িতে যে রিমি আন্টি পড়াতে আসেন তিনিই তিতলির হোমটাস্কগুলো করে দেন আর তিনিও তেমন বোঝাতে পারেন না, বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারেন না।
কিন্তু বিল্টুদা এমন সুন্দরভাবে বোঝায় সবকিছুই সহজ মনে হয়। সেগুলো আর পড়তে হবে না।আশ্চৰ্য ব্যাপার,যে প্রশ্নগুলোর উত্তর এতদিন কেউ দিতে পারেনি সব উত্তরই তার জানা ! নিজের দাদা যে কেমন হয় তিতলি জানতো না, জেনে গেল এই কদিনে। কী আদর কী ভালোবাসা!সবসময় বুনু আর বুনু।
বিল্টুদা জানে বাবুইপাখি কেমন করে বাসা বাঁধে, চিল এতদূর থেকে ভালো দেখতে পায় কেন, ব্যাং কীভাবে শিকার ধরে, বেজি আর সাপের লড়াই হলে সাপ কেন জিততে পারে না, সাপ আমাদের কী উপকার করে........আরও কত কী ! সে সবই জানে।
তিতলি আর প্রশ্নই খুঁজে পায় না যার উত্তর বিল্টুদা জানে না। এই কদিনে সববিষয়ের হোমটাস্ক শিখিয়ে দিয়েছে বিল্টুদা তারপর সবই সে নিজে করেছে।পড়া বুঝতে কোনো অসুবিধা হয়নি।এমনকী হাতের লেখা কীভাবে ভালো করা যায় তার টিপসও দিয়েছে।
আজ স্কুলে একটাও বকুনি খায়নি সে।দাদা খুব মজার রূপকথার গল্প জানে. আসলে বহুদিন সে মাসির বাড়ি যায়নি তাই বিল্টুদাকে সে ভালো চিনতো না, এখন আর ছাড়তেই চায় না। মেসোমশাই কাল এসে তাকে নিয়ে গেছেন।
তবে বিল্টুদা বারবার বলে গেছে,বুনু, গরমের ছুটিতে আমাদের বাড়ি যাস।তোকে আমাদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবো তখন বাকি গল্পগুলো বলবো কেমন ! সে আরও বলেছে, কঠিন অঙ্কগুলো সহজে করার নিয়মও শিখিয়ে দেবে। বেচারা তিতলির সময় যেন কাটতেই চায় না, আর দিনগুলো মনে হয় খুব বড়ো হয়ে গেছে।যদিও এটা পৌষমাস তবু দিন যেন শেষই হচ্ছে না।সামার ভ্যাকেশন তো অনেক দূরে ততদিন কী হবে?
আবার সেই গোমড়ামুখ মিস -এর দল !বাবা -মায়ের ব্যাজার মুখ........
আরও খারাপ কত কী !
ভাবতে ভাবতে তিতলির দুচোখ জলে ভরে ওঠে।তার মনখারাপ লাগছে।
সমাপ্ত
কোন মন্তব্য নেই