কথা সাহিত্যিক আব্দুর রউফ চৌধুরী রচনা সমগ্র
দ্রোহী কথা সাহিত্যিক আব্দুর রউফ চৌধুরী এক স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর, এক ভিন্ন ঘরানা বহু মাত্রিক প্রতিভার অধিকারী আব্দুর রউফ চৌধুরী (১৯২৯-১৯৯৬) আধুনিকোত্তর বাংলা সাহিত্যের দ্রোহী কথা সাহিত্যিক। তিনি সনিষ্ঠায় ও সৃজন শীলতায় অতুলনীয়―তাঁর সাহিত্য চর্চা ও পাঠের মধ্য দিয়ে একজন বাঙালি ক্রমাগত চেতনা ও মননে জাগরিত হয়ে উঠতে পারে।
বস্তুত তিনি ছিলেন বাংলা-সাহিত্য জগতে দ্রোহী কথা সাহিত্যের
নির্মিতি ও মর্মাংশে এক শুদ্ধ আধুনিকোত্তরক। যুগাত্মক জটিল চেতনা প্রবাহী আঙ্গিকে তিনি ছিলেন চূঁড়া বিহারী
এবং বিয়ষ-বস্তু-ঘটনাও অতিশয় কাল চৈতন্যবাহী ও বিস্ময়সূচক।
তাঁর সৃজনশীলতা, শিল্পশৈলী, কালচেতনার প্রতি ঐকান্তিকতা ও অভিনিবেশ গড়ে তোলার
জন্য এবং ‘প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পৌঁছে দেবো তোমারই দ্রোহী শব্দাবলি’র অঙ্গীকারে
আবদ্ধ হয়ে দেওয়ান আতিকুর রহমানের প্রচ্ছদে ছয়শত আটচল্লিশ পৃষ্ঠার বৃহৎ কলেবরে
‘আব্দুর রউফ চৌধুরী/রচনা সমগ্র’ (প্রথম খন্ড) প্রকাশ করেছে ইত্যাদী গ্রন্থ
প্রকাশ।
এতে পাঠক মাত্রই উজ্জীবিত ও
আরো অনু সন্ধিৎসু হয়ে উঠবেন এমনটাই প্রত্যাশ
করেন প্রকাশক, শুধু তাই নয়— সত্যিকার অর্থে পাঠকও পাঠ করবার মতো পাবে এক অনন্য সাধারণ
গ্রন্থ।
গ্রন্থের বিষয় সূচিতে আলোচ্য ‘নতুন দিগন্ত’-এর বিষয় ও শিল্পরূপ এবং
কবিতায় মুক্তি যুদ্ধ ও অগ্রন্থিত বিস্ময় নিয়ে
আলোচনা করেছেন ড. মুকিদ চৌধুরী। এছাড়াও গ্রন্থে আব্দুর রউফ চৌধুরীর ৪৬৪ পাতা অর্থাৎ ২৯ ফর্মার অখন্ড বৃহৎ উপন্যাস ‘নতুন
দিগন্ত’ এবং ‘৭১-এর কবিতা’, ‘কবিতা গুচ্ছ’ও স্থান
পেয়েছে।
পরিশেষে সংযোজন করা হয়েছে আব্দুল মান্নান সৈয়দ-এর ‘নতুন
দিগন্ত সমগ্র’ (ভূমিকা), সালেহা চৌধুরীর ‘নতুন দিগন্তের স্বপ্ন’, পার্থ সারথি চৌধুরীর ‘উৎস বা শেকড়ের টান’, খাদিজা আক্তারের
‘অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের যুগপৎ সম্মিলন’, বর্ষা আহমেদ-এর ‘রাজনৈতিক ইতিহাস আর জীবনের গল্প
নতুন দিগন্ত’।
এই দ্রোহী কথা সাহিত্যিকের ত্রিনয়নে ধরা পড়েছে অনেক অনাবাদী সাহিত্যের জমিন—বলতে গেলে সাহিত্যের সকল শাখায় সমানে কলম চালিয়েছেন। কোনো প্রকার কল্প-কৌটিল্য, অবান্তর কিম্বা
অবাস্তব বিষয়ের উপর মেদী সাহিত্য তিনি রচনা করেন নি।
দূর প্রবাসে বসেও স্বভূমির মানুষ তার রাজনীতি, অর্থনীতি, অভাব, যন্ত্রণা ক্লেশ জীবন,
অন্যায়-অনাচার-অস্বচ্ছতা এবং সকল
বৈষম্যের বায়বীয় সমস্যার উৎস থেকে টেনে বের করেছেন শব্দ শিল্পের অবারিত সুশাসনে। কোনোপ্রকার আপোষ না ব্যক্তি জীবনে, না কলম জীবনে।
“মাটির তিলক-রেখাকে আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম প্রাপ্তি বলে
গণ্য করব এবং মাটির খুব
কাছাকাছি থাকার বাসনায় তৃতীয় বারের মতো বাসা
বাঁধব এখানেই।”―নাসিমের স্বগতোক্তি, নতুন দিগন্ত
নতুন দিগন্ত উপন্যাসে অনেক চরিত্রের মধ্যে নায়ক চরিত্র নাসিম তার মূল লক্ষ্য খুঁজে বেড়াচ্ছে। তাকে কেন্দ্র করে যে আখ্যান মঞ্জরিত হয়ে উঠেছে, সেখানে—জুলফি আলি ভুট্টোও একটি প্রধান চরিত্র। দীর্ঘ কাহিনীর মধ্যে একটি জাতির জাগরণের পরোক্ষ ইতিহাস মুদ্রিত হয়েছে আবার তারই সঙ্গে আছে ব্যক্তির অন্তর্গত অজস্র টানা পোড়েন। ভুট্টোর ব্যাভিচার পরিষ্কার রূপায়িত যেমন, তেমনি ভুট্টোর দ্বিতীয় স্ত্রী নাহিদার সঙ্গে নাসিমের সম্পর্কের বর্তমান ও অতীত চারণা।
ভুট্টো ও নাসিম, দুজনেরই রাজনৈতিক জীবনকে যে-ব্যক্তি জীবন অনেকখানি
প্রভাবিত করেছে, তা দেখিয়েছেন লেখক। প্রধান দুটো চরিত্র নাসিম ও ভুট্টো।
এছাড়াও অনেক চরিত্র—আন্নী, বেনফরত, নূর মোহম্মদ, আব্দুল্লা খুরো, ফারুক, পারভেজ, যতীন চক্রবর্ত্তী, মতিন, অন্তার, নাসিমা, মখসুদ, নাহিদা, সুরাইয়া, রোকশানা, খুরশেদ আহমেদ পাতৌদি, আসলাম প্রমুখ।
প্রধান-অপ্রধান এসব চরিত্র জীবন তরঙ্গে উৎক্ষিপ্ত, আবার সমাজের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা। চরিত্র নির্মাণে
লেখকের প্রধান একটি হাতিয়ার সংলাপ। করাচির মুখ্যপটভূমিতে যে উপন্যাস, স্বাভাবিক ভাবেই
তার সংলাপের ভাষা হতে পারে উর্দু। কিন্তু বাংলা ভাষায় রচিত উপন্যাসে তো এ ভাষা
অবিকল ব্যবহার করা সম্ভব নয়।
উপন্যাসে বাঙালি নাসিমের প্রবেশের পরে প্রথমেই প্রসঙ্গটা
এসেছে—‘লাহোরের অদূরে ওয়াগারের
সীমান্ত রক্ষী পাকিস্তানি এক সেপাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল নাসিমের। সেপাই
নাসিমকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুছি কোন হু?’ জবাবে নাসিম বলল, ‘মে পাকিস্তানি
হ্যায়।’ [...]’ এই নাসিম ক্রমে উর্দুভাষা অনেকখানি আয়ত্ত করে।
লেখক সংলাপের প্রয়োজনে উর্দু প্রয়োগ করেছেন। পুরো উপন্যাসের
মূল সুর দেশ ও জাতির সাধারণ সমাজ কে ঘিরে, বিশেষ করে ‘যুব শক্তিকে বিভ্রান্ত ও বিপদাপন্ন পথ
থেকে উদ্ধার করতে হবে—তাদের রক্ষা করতে হবে—আর তাদের রক্ষা করতে হলে অসুন্দর,
অসত্যের বিরুদ্ধে সু-পরিকল্পিতভাবে বিপ্লবের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
তাদের শিক্ষা দিতে হবে আত্মদান, সাহসিকতা, ভয়শূন্য মৃত্যুর।’ মুলত পরাধীন ব্রিটিশ ভারতের অগ্নি যুগের
বিপ্লবী গাথার প্রাণিত পথ ও ৭১-এর মহান মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস কে আশ্রয় করে ঔপন্যাসিক অয়োময় সমাজকে
পরিবর্তন করতে চেয়েছেন। তবে উপন্যাস তো শুধু কাহিনীর সংগ্রন্থন নয়, তার চেয়ে বেশি
কিছু―কাহিনীর ফ্রেম উপচে পড়াতেই তার অন্তিম সাফল্য।
উপন্যাস কাহিনীকে ছাড়িয়ে কোনো তাৎপর্য কি অন্বেষণ করবে না? করবেই তো। ‘নতুন দিগন্ত’ উপন্যাসেও সেই সন্ধান আছে। বস্তুত উপন্যাসের নায়ক
নাসিমের সমগ্র চিন্তা ও প্রতিজ্ঞার সারাৎসার প্রতিভাত হয়েছে নানা অনুচ্ছেদে।
উপমা-উৎপ্রেক্ষার
প্রয়োগ যেমন লেখকের দেশজতা-ইতিহাস চেতনাকে উদ্ভাসিত করে, তেমনি বর্ণনার
মধ্যে এরকম কথা ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে লেখকের উদ্দেশ্য উজ্জ্বল হয়ে উঠে।‘নতুন দিগন্ত
সমগ্র’-এর ভূমিকায় আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেন—-“আব্দুর রউফ চৌধুরীর ‘পরদেশে পরবাসী’ বই-এর ভিতরে যত প্রবেশ করতে লাগলাম, তত অনুভব করলাম
আমি এক অজানা অভিজ্ঞতার শরিক ও স্নাতক হয়ে
চলেছি।
ভিতর থেকে ধ্বনিত হলো একটি স্বতঃস্ফূর্ত ‘বাহবা’। পরিষ্কার বোঝা
গেল―এঁর সঙ্গে ঠিক সিলেটের অন্য কোনো লেখকের সঙ্গে সাযুজ্য নেই। আব্দুর রউফ চৌধুরী এক স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর, এক ভিন্ন ঘরানা। আব্দুর রউফ চৌধুরীর স্রোতে-প্রতি স্রোতে আবর্তমান নতুন দিগন্ত উপন্যাসটি যত বড় তার
চেয়ে মনে হয় অনেক বৃহৎ। এই ব্যাপ্তি উপন্যাসটির পৃষ্ঠা সংখ্যার চেযে বেশি।
সুনিবদ্ধ কাহিনি, অগণন চরিত্র, উজ্জীবিত সংলাপ,
স্বগত সংলাপ, স্মৃতি, ইতিহাস, বিশ্লেষণ, বর্ণনা―সবকিছু ছাপিয়ে যায় লেখকের জীবনবেদ।” ভারত-পাকিস্তান-বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল এই উপন্যাসে বিস্তৃত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বাভাসও উহ্য থাকে না। মানুষের অন্ধকার জীবনও হয়ে ওঠে মূল বিষয়।
একই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন মানুষের চরিত্র, উৎস বা শেকড়ের টান
দেন লেখক। তবে বাঙালির আত্মগৌরব—উপন্যাসের একটি স্পন্দমান বিষয়।
বিশাল পৃষ্ঠা বহরে বৃহৎ উপন্যাস
‘নতুন দিগন্ত’র সাথে তিনফর্মায় ‘৭১-এর কবিতা’ ও ‘কবিতা গুচ্ছ’ ঠাঁই পেয়েছে। তাঁর
কবিতায় ব্যাপৃত মুক্তিযুদ্ধ। ভারতবর্ষ বিভাজনের পরবর্তী সময় প্রবাহে বাংলাদেশের
সচেতন অনেক কবি-সাহিত্যিকরা দ্বিধান্বিত হলেও তিনি ছিলেন পাকিস্তানবাদী জীবনভাবনা ও
মূল্যবোধের বিপরীতে; পাকিস্তানবিরোধী ছিলেন তিনি সর্বক্ষেত্রে।
তাঁর বিশাল সৃষ্টি জগতে (গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতা ও অন্যান্য
সাহিত্যাঙ্গনে) দেখা যায়, পাকিস্তানের প্রতি দ্রোহের অভিব্যক্তি। ষোল আনা তাঁর জীবন ও
ভাবনা জুড়ে ছিল বাঙালি
মূল্যবোধ। তাঁর কবিতায় সবচেযে বড় বিষয়—তিনি দেশকে, দেশের আত্মাকে
ভালোবেসে ছিলেন।
এসব কবিতায় আছে বারুদের গন্ধ, ঘামের গন্ধ,
রক্তের গন্ধ আর মুক্তির গন্ধ। “বাংলায় জানু পেতে বসেছে পাক-শয়তান এবার/
অস্ত্রাঘাতে ধ্বংস করে দিতে চায় নিখিল-অখিল বঙ্গ [...]।”―‘থাক তোরা বিভোর’। কাব্য ভাবনা ও শিল্পনির্মাণে পরিণত রউফচেতনা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শিহরিত ও স্পন্দিত—
“নূতন মানচিত্রের মাটির উপর/ চিত হয়ে সে শুয়ে আছে, গ্রীষ্ম দুপুরে/
উন্মুক্ত শ্যামপ্রান্তরে/ কেউ নেই তার পাশে, শুধু/ বিদেশি
শকুনের তীক্ষ্নদৃষ্টি তার উপর...।”―‘মানচিত্র’।
দ্রোহী কথা সাহিত্যিক আব্দুর রউফ চৌধুরীর কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ এভাবেই প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর চেতনারই পল্লবিত শব্দরূপ, রক্তাক্ত শব্দ বহ্নিমালা। ইতিহাসের যে-অনিবার্য গতি প্রবাহ ঐক্যবদ্ধ মুক্তি যুদ্ধের সফলতার ইঙ্গিত বহন করে, দ্রোহী কথা সাহিত্যিক আব্দুর রউফ চৌধুরী তাঁর কবিতায় সেই মুক্তি যুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার সমান্তরাল গৌরবময় ভূমিকা নির্মাণ করেছেন।
“পাকিস্তানি শকুন দেখে আমি ছটফট করি হে মুক্তি যুদ্ধ/ আমার
গলা শুকিয়ে চিতার কাঠ...।”―‘শকুন’। আবার, যুদ্ধদিনেও প্রেমের ছড়ি হাত ঘুরোয় মুক্তির আনন্দে―“তবে প্রেম কী হে কমরেড/ সুপ্রিয় কমরেড,/ প্রেম গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে/ মুক্তির রণক্ষেত্রে, মুক্তির
শবলাশে...।”―‘সুপ্রিয় কমরেড’।
মুক্তি যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং দেশের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা তাকে বারবার ফিরিয়ে আনে নিজেরর সমাজে, নিজের মানুষের
কাছে। আর তাদের দগ্ধ যুগ-যন্ত্রণার কাছে।
‘৭১-এর কবিতা’র কাব্যচিত্রে
তীব্র দেশপ্রেম আর স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি বিশ্বস্ততাই তাঁকে দ্রোহী করে
তুলেছে। অপরদিকে, ‘কবিতা গুচ্ছ’-এর মুখ্য উপাদান হয়ে ওঠে রাজনীতি ও প্রেম।
“প্রেমিকের নাকে মদের গন্ধ―নারীর গন্ধ/ কবিতার নৌকো ভেসে চলে জীবনসৈকতে/ মেঘে-বজ্রে ঢেকে যায় সপ্ত-সিন্ধু-আকাশ [...]।”—‘একটি বাতাবি লেবু।’
কোন মন্তব্য নেই